মুন্সিগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। পাকিস্তান পর্বের শেষ তিন বছর আওয়ামী লীগের হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, পরে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার সরকারি দায়িত্ব পান। প্রায় সাত বছর বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। সেই সময়ের অনেক কথা তিনি ১০ আগস্ট ঢাকাটাইমসকে অকপটে বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নতুন কিছু দিক উন্মোচন করেছেন। আজ সাক্ষাৎকারের তৃতীয় ও শেষ কিস্তি ছাপা হলো। মুন্সিগঞ্জ গিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তায়েব মিল্লাত হোসেন।
আপনাকে নিয়ে একটি বই বের হয়েছে- বঙ্গবন্ধুর মহিউদ্দিন। এই নামকরণের কারণ কী?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : এটারও একটা ঘটনা আছে। সকাল সাড়ে আটটায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ডিউটিতে যেতাম। একদিন বঙ্গবন্ধুর বাসার দোতলায় গিয়েছি। দেখি, বঙ্গবন্ধু গোসলখানা থেকে পা মুছতে মুছতে বের হচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘টেবিলের উপর তোর একটা চিঠি এসেছে, চিঠিটা দেখ।’
চিঠিটা হাতে নিয়ে খামটা খুলতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘চিঠির খামের উপর কি লেখা আছে সেটা পড়।’ আমি খামের উপরের লেখাটি পড়লাম, লেখা ছিল- ‘বঙ্গবন্ধুর মহিউদ্দিন, ৩২ নম্বর ধানমন্ডি।’
আমি বিষয়টি বুঝতে পারলাম না। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আবার পড়’। লেখাটা আবার পড়লাম, এই লেখাটি উপলব্ধি করতে পারলাম না। এর গভীরতা বুঝতে পারলাম না। বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, ‘‘কী লিখেছে, ‘বঙ্গবন্ধুর মহিউদ্দিন’, এটা মেনে চলবি।’’ তখন আমি এর মর্ম বুঝতে পারলাম।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার শেষ কর্মদিবস কবে? এই দিনটি কেমন ছিল?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : বঙ্গবন্ধুর শেষ কর্মদিবস আমারও নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে শেষ কর্মদিবস। দিনটি পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সকাল ৯টার মধ্যে অফিসে আসি। অফিস ছিল নতুন গণভবনে, যথারীতি কার্যক্রম শেষ করে বিকালে রাজনৈতিক বিভিন্ন লোকজনের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেন। বিকালে নেতানেত্রীদের সঙ্গে আবদুল মতিন চৌধুরীও (তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘আগামীকাল বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপুর্ণ ভাষণ দেবেন। এদিকে সময় নষ্ট না করে বঙ্গবন্ধুকে বাসায় নিয়ে যাও। ওনাকে কালকের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ভাবতে দাও।’
তার কথা মতো আমি বঙ্গবন্ধুকে বাসায় নেওয়ার জন্য প্রতিদিনের মতো বঙ্গবন্ধুর চশমা, তামাকের বেগ টেবিল থেকে হাতে নেই। তখন বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন, তাকে বাড়ি যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে ধমক দিয়ে ওইগুলো টেবিলে রাখতে নির্দেশ দিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে উঠাতে পারলাম না। মতিন চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘কী ব্যাপার?’ আমি বললাম, ‘আমি তো ওঠাতে পারছি না।’ তিনি বললেন ‘আমার সঙ্গে আসো।’ তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে আমাকে জোরে বলতে লাগলেন- ‘হিউদ্দিন গাড়ি লাগিয়েছ।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ গাড়ি প্রস্তুত।’ বঙ্গবন্ধু তখন তাকে বললেন, ‘আপনিও আমার পেছনে লেগেছেন।’
বঙ্গবন্ধু চেয়ার থেকে উঠে ৩২ নম্বর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন। রাত সাড়ে ৮টা-৯টার দিকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৩২ নম্বর বাড়িতে গণভবনের দিকে চলে আসলাম। সেখানে এক নৈশভোজে যোগ দিলাম।
নৈশভোজ শেষে আমি ও তোফায়েল আহমেদ ভাই একসঙ্গে গণভবন থেকে বের হলাম। তোফায়েল ভাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার কথা বললেন। রাত অনেক হয়েছে বলে আমি আর গেলাম না। কারণ বেশি রাতে আমাকে দেখলে বঙ্গবন্ধু অসন্তুষ্ট হতে পারেন। তোফায়েল ভাই আমাকে ৩২ নম্বর বাসার নিচে রেখে উপরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। এই সময় আমার সঙ্গে কাজী গোলাম মোস্তফা সাহেবের দেখা হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লিডার কী করছেন?’ আমি বললাম, ‘স্যার উপরে আছেন।’ তিনি তখন উপরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তোফায়েল ভাই নিচে নেমে আসলেন। আমি ও তোফায়েল ভাই বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেই। তাকে তার বাড়িতে নামিয়ে আমি রাত প্রায় একটার দিকে নিজের বাসায় ফিরি।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর কখন পেলেন?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : গোলাগুলির আওয়াজে কর্মচারীরা আমাকে ঘুম থেকে উঠায়। রমনা থানার পাশেই ছিল আমার বাসা। আমি ভাবলাম, বঙ্গবন্ধু আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন, এই অনুষ্ঠান বানচাল করার জন্য হয়ত দুষ্কৃতকারীরা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। সেলিনা হক নামে এক নেত্রী শেষরাতে আমাকে ফোন করে জানালেন, বঙ্গবন্ধুর বাসায় দুষ্কৃতকারীরা হামলা করেছে।
আমি তখন বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাওয়ার কোনো পরিবহন না থাকার কারণে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের স্টাফদের ফোন করি। কিন্তু কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ঘটনা জানতে কিছুক্ষণ পর তৌফিক ইমাম সাহেব ফোন করলেন। আমি ধারণা থেকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতকারীরা এই কাজ করছে।’
লাল ফোনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করলাম, কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি। তখনি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। ২৭ নম্বর ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের সামনে যাওয়ার পর ওখানকার লোকজন আমাকে আর সামনে যেতে দিল না। তারা বললেন, সামনে আর্মি আর রক্ষীবাহিনীদের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে। আমি ভাবলাম আমাকে দেখলে সবাই চিনতে পারবে, এই ভেবে আমি বাধা থাকার পরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সামনে গিয়ে দেখি বৃষ্টির মতো আগুনের গোলা সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। ভাবলাম গুলি তো আর আমাকে চিনবে না। বাসায় ফিরে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে লাগলাম। একপর্যায়ে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর উপর হামলা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর রেডিওর খবরে শোনা গেল, খোন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করা হয়েছে। এই সময় ফরাসউদ্দিন সাহেব (বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব) আমাকে ফোন করে বঙ্গবন্ধুর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তার কিছুক্ষণ পর ড্রইং রুমে রেডিওতে শুনি, ‘আমিমেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী সরকার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’
১৯৭৫ সালের ২৮ অক্টোবর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাখা হয় জেলখানার দুই নম্বর নতুন সেলে। জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে দেখেছি। খাবার দিতে আসা মিঞা সাহেব (জেল পুলিশ) ৩ নভেম্বর চার আঙুলের ইশারায় জানিয়েছিলেন, জাতীয় চার নেতাকে মেরে ফেলা হয়েছে। দুই দিন ধরে তখন কিছুই খেতে পারিনি। চারদিকে লাশের গন্ধ। দুই দিন পর চার নেতার লাশ জেলখানা থেকে সরিয়ে ফেলে। প্রায় সাড়ে ৩ বছর আমাকে কারাগারে কাটাতে হয়। উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে এরপর জেলখানা থেকে বের হই। জেলে থাকার সময় তৎকালীন সরকার কখনো লোভ-লালসা, কখনো ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের দলে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন আমার একটাই বক্তব্য ছিল, ‘যার পায়ের নিচে থেকেছি, তার পায়ের নিচে থেকে মৃত্যুবরণ করতে পারিনি। এখন কোনো পদ-পদবির লোভ-লালসা কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাকে বঙ্গবন্ধুর দল থেকে সরাতে পারবেন না।’
রাজনৈতিক জীবনে দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে এসে নিজের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কিভাবে করবেন?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো, বঙ্গবন্ধুর পায়ের তলে স্থান পেয়েছিলাম। আর আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হলো, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মরতে পারি নাই।