প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৮:৪৮:০০আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৮:৫২:৩৪
‘সেলিম আল দীন বললেন, খুব ভালো ছবি বানিয়েছিস’
ঢাকাটাইমস
মোরশেদুল ইসলাম নির্মাতাজীবনের প্রায় তিন যুগ পার করেছেন। বিকল্পধারার কাজের মধ্য দিয়ে যে কজন নির্মাতা সাফল্য পেয়েছেন তাদের অন্যতম তিনি। আশির দশকের গোড়ায় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পথচলা শুরু। আগামী, চাকা, দীপু নাম্বার টু, দুখাই, আমার বন্ধু রাশেদ, অনিল বাগচীর একদিন-এর মতো প্রশংসিত অনেক চলচ্চিত্র এসেছে তার হাত ধরে। একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও বৈশ্বিক পর্যায় থেকেও নানা সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। তার নির্মাতা হয়ে ওঠার গল্প, চলচ্চিত্র আন্দোলনের নানা দিক অকপটে বলেছেন ঢাকাটাইমসকে। আলাপের তৃতীয় ও শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো আজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দঋয়াদ।
আপনারশৈশবেরকথাজানতেচাই।
গ্রামে কখনো থাকিনি, থাকা হয়নি। তবে ছোটবেলায় গ্রামে যেতাম মায়ের সঙ্গে। আমাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মাঝে মধ্যে বছরে এক দুবার যাই। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বছরে দুই বার যেতাম। যখন স্কুল বন্ধ হতো তখন এক দুই মাস থাকা হতো। সুতরাং ওই স্মৃতিগুলো আছে। গ্রামের বর্ষাকালটা আমার খুব ভালো লাগে। কারণ বর্ষাকালে আমার খুব বেশি যাওয়া হতো। কারণ তখন স্কুল বন্ধ থাকত। বর্ষাকালে আমরা নৌকা নিয়ে যেতাম। সবই আমার মনে আছে। তারপর গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলতাম। কখনো খেলা দেখতাম। আমার খুব ভালো মনে আছে তখন আমার সমবয়সী অনেকেই ছিল। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম এবং গ্রামে গেলে ছোটবেলায় আমি মিলাদ পড়াইতাম। বাতাসা কিনে আনা হতো। আর আমি মিলাদ পড়াতাম। তখন গ্রামে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। না থাকার কারণে সন্ধ্যা বেলা কুপি জ্বালানো বা হারিকেন ধরানো হতো। চারদিকে অন্ধকারের আলাদা একটা মজা ছিল, যেটা এখন হারিয়ে গেছে । তবে গ্রাম এখনো গ্রাম। গ্রামের সৌন্দর্যটা, গ্রামের যে একটা শান্ত নিরিবিলি ব্যাপার, শহরের কোলাহল থেকে বাইরে। এসব স্মৃতি এখনও জ¦লজ্বলে।
‘আগামী’সিনেমারপরেকীকরেছেন?
‘আগামী’ ছবির পর আমি মাঝখানে একটা ডকুমেন্টারি করলাম। চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে। সেখানকার। ডিরেক্টর ছিলেন সৈয়দ তসলিম ইসলাম। বাংলাদেশের খুব নামি চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন উনি। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি যেহেতু সফল হলাম, উনি আমাকে ডেকে একটা ছবি দিলেন । নৌকার সঙ্গে মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে তাদের নিয়ে একটি ছবি করার। আমি চারটা সম্প্রদায়কে বেছে নিয়েছিলাম; মাঝি, বেদে, জেলে এবং বাওয়ালী। এদেরকে নিয়ে আমি ছবিটা করলাম। এটা ৩৫ মিলিমিটারে হয়েছিল এবং এটি ছিল ২০ মিনিটের। এবং পরে ওই ছবিটার কয়েকটি ভাষায় সাব টাইটেল করা হয়। তার পর করলাম আমি ‘সূচনা’। এই ছবির বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ এবং তার সঙ্গে কিছুটা রাজনীতি ছিল। রাজনীতির অবক্ষয় ও বামপন্থি রাজনীতির যে বিকৃতি, তাও এই ছবিতে উঠে এসেছিল । আমার ওই ছবিতে আমি এটা দেখিয়েছি। আমি দেখিয়েছি গ্রামের একটা সহজ সরল তরুণ যুদ্ধের সময় তার বাবা-মাকে মেরে ফেলে এবং সে একা হয়ে যায়। তাদের সব সম্পত্তি দখল করে নেয় গ্রামের মাতŸর। যেটাতে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন। আর যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন হুমায়ুন ফরীদি। মাতবর সব দখল করে নেয়। যুবকটা অনেকটা আশ্রিতের মতো আছে। সে একটু বোকা, এত কিছু বোঝে না। সে অনেকটা কাজের ছেলের মতোই আছে । একসময় সে গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। এর মাঝে গ্রামের ওই মাতবরের বাসায় একটা মেয়ে কাজ করে, মাতবর তার প্রতি লোভ থাকে। ছেলেটা শহরে এসে কায়িক জীবন শুরু করে। স্ট্রাগল করতে থাকে। সেখানে তার রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে পরিচয় হয়। প্রথমদিকে সে তার কথাবার্তায় খুব মুগ্ধ হয় । পরের দিকে দেখা যায় তার খারাপ একটা দিক। রাজনৈতিক দিক থেকে তার প্রথম দিকে চমৎকার কথাবার্তা বলতে থাকে এবং শহীদ মিনারে যায়। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, সে লোকটা অন্যায়ের ক্ষেত্রে আপসকারী বা চাটুকারিতা করছে। সেটা দেখে ছেলেটা খুব হতাশ হয়। ছেলেটা আবার সরল মনে গ্রামে ফিরে যায়। গ্রামে ফিরে দেখে ওই মেয়েটাকে নির্যাতন করছে মাতবর। ঘরে একটা বন্দুক ছিল, সে ঘরে ঢুকে সেই বন্দুক নিয়ে মাতবরকে গুলি করে। এইভাবে ছবিটা শেষ হয়। ছবিতে আমি রাজনৈতিক ব্যাপারও আনার চেষ্টা করেছি। এটা ১৯৮৮ সালে।
আপনাদেরসময়েবিদেশিফিল্মদেখারসুযোগকতটুকুছিল?
আমরা তখন বাইরের কিছু কিছু ছবি দেখার সুযোগ পাচ্ছি। তখন পলিটিক্যাল ফিল্ম দেখছি। তবে খুব যে বেশি ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি তাও নয়। তখন কিন্তু ছবি দেখার সুযোগ সীমিত ছিল, তখন শুধু বিদেশি যেসব দূতাবাস ছিল তারা যে ছবিগুলো নিয়ে আসতো শুধু সেগুলোই দেখা যেত। ওই সময়ে সব ধরনের ফিল্ম নিয়েই আলোচনা হতো। তবে আমাদের নিজেদের দেশের স্বকীয়তা নিয়ে, নিজস্বতা নিয়ে আমরা আলোচনা করে কাজ করেছি। আমাদের ওই সময় একটা বিশেষ বিষয় মাথায় ছিল, আমাদের চলচ্চিত্রের নিজস্বতা নিয়েই আমরা আন্দোলন চালিয়েছি। অন্যদের ছবি অনুকরণ করে করিনি। আমাদের সেই আন্দোলন যে খুব বেশি বৈপ্লবিক আন্দোলন ছিল তাও কিন্তু নয়। কারণ আমরা ছবিগুলো করে সেন্সর করাতাম। তারপর দেখাতাম। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে, সেন্সরে না দেখিয়ে নিজেরা প্রদর্শন করব, এই রকম জঙ্গি মনোভাব আমাদের ছিল না। এমন বিদেশের অনেক ছবি আছে তারা আন্ডার গ্রাউন্ডে ছবি বানিয়েছে। যেমন ভারতও পলিটিক্যাল ছবি বানিয়েছে, তবে তারা আইন মেনেই কাজ করেছেন।
চলচ্চিত্রেবিনিয়োগকারীদেরনিয়েআপনারঅভিজ্ঞতাকী?
আমার ‘আগামী’ ছবিতে কয়েক গুণ বেশি টাকা এসেছে। সব ক্ষেত্রে প্রবলেম ছিল তাও কিন্তু নয়। ভারতের চলচ্চিত্র উৎসবে যখন এটা শ্রেষ্ঠ পরিচালনার জন্য রৌপ্য পদক পুরস্কার পেল তখন (১৯৮৫ সালে) অন্যরাও কিন্তু বেশ উৎসাহী হলো। তারপর যখন আমার ‘সূচনা’ ছবিটি বানিয়েছি ওটাতে মোটামুটি তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছিল। ইফতেখারুল আলম যিনি চলচ্চিত্র প্রযোজক ছিলেন, তিনি আমাকে হেল্প করেছিলেন। তিনি কিছু ছবি দিয়েছিলেন করার জন্য, টাকাও দিয়েছিলেন। বাকি টাকা এদিক সেদিক থেকে জোগাড় করে আমি ছবিটি বানিয়েছি। তারপর ‘চাকা’ ছবিটি বানালাম। এর জন্য আমার এক বন্ধু কিছু টাকা দিয়েছিল। এটি ১৯৯৩ সালে বানিয়েছি।
‘চাকা’কিভাবেনির্মিতহলো?
আফজাল-সুবর্ণাকে নিয়ে আমার একটা ছবি বানানোর কথা ছিল ‘খেলাঘর’। সেই ছবিটা আমি অনেক পরে বানিয়েছি। ওই ছবিতে আমি কাস্টিং করেছি আফজাল-সুবর্ণাকে। এটা ৯০ সালে। আমি তখন লোকেশন দেখছি। একদিন আফজাল ভাইকে নিয়ে লোকেশন দেখতে গেলাম । আফজাল ভাই আমাকে বললেন মঞ্চের নাটকটি দেখ। তখন নাটকটি মঞ্চে এসেছে । আমি পরের শোতে দেখলাম। দেখে আমার খুবই ভালো লাগল । কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এটা কিভাবে ছবি হবে। এত সংলাপ প্রধান নাটক আমি কিভাবে করব? পরে আমি অনেক ভাবলাম যদি প্লটটা নিয়ে পুরো জিনিসটা আমি আমার মতো করে সাজিয়ে নিই তাহলে ছবি হতে পারে। সেভাবে করলাম। আর আমার চিত্রনাট্যে সংলাপ খুবই কম ছিল। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে প্রকৃতি এবং মানুষের সঙ্গে যে সম্পর্ক, সেখানে যত বশি প্রাধান্য পাবে এবং যত বেশি নিস্তব্ধ থাকবে, তত বেশি হয়ত বিষয়গুলো প্রকাশ পাবে। আমি সেভাবেই চিত্রনাট্য লিখলাম। এর পর আমি সেলিম ভাইয়ের (সেলিম আল দীন) কাছে গেলাম পারমিশন নিতে। সেলিম ভাই বললেন ঠিক আছে পারমিশন দিলাম। কিন্তু স্ক্রিপ্টটা এডিট করতে হবে। উনি বললেন, ছবিতে ডায়ালগ কই? আমি বললাম আমার ছবিতে তো তেমন ডায়ালগ থাকবে না। কিন্তু আমি যদি লিখি তা ডায়ালগ সহকারে অনেক বেশি ভালো হবে। আমি কিন্তু সেই ভালো ডায়ালগ চাচ্ছি না অনেকবার বলতেছি। সেলিম ভাই খুব ক্ষেপে যাচ্ছেন। তুই আমার কোনো কথাই শুনিস না। শেষে আমি বললাম সেলিম ভাই আপনি যদি ছবিটির পারমিশন (অনুমতি) নাও দেন তবুও আমি ছবিটি বানাব। আমি শুধু লিখে দেব সেলিম আল দীনের ‘চাকা’ নাটক দ্বারা অনুপ্রাণিত। সেখানে আপনার পারমিশনও লাগবে না। কেউ কিছু বলতেও পারবে না। তখন টিএন্ডটিতে ফোন এলো পরের দিন। আমার তখন ‘শিল্পী’ নামে ছোট একটি ফার্ম ছিল। আমি এটা ৮৭ সালে শুরু করেছিলাম। পরে সেলিম ভাই বললেন তুই তো আমার কোনো কথা শুনিসনি, তবে ছবিটি কর, আমার নামটা অন্তত রাখ। তো এই হলো চাকার ব্যাপার। ‘চাকা’ ছবিটি করার পর যখন প্রথম প্রিমিয়ার শো হলো, তখন কিন্তু ম্যাক্সিমাম লোকেরা ছবিটি দেখেছে ।
সেলিমআলদীনএটাদেখে কীবললেন?
এটা নিয়ে অনেকে অপছন্দ করেছে, অনেকে লেখালেখিও করেছে। সেলিম ভাই ছবি দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, ‘খুব ভালো ছবি বানিয়েছিস তুই।’ এটা বানাতে আমার প্রযোজনার জায়গা থেকে প্রায় ৬-৭ লাখ টাকা লেগে গেছে। আমার এক বন্ধু আমাকে ৫ লাখ টাকা দিয়েছিল। সে ভালো ব্যবসা করছিল। সৈয়দ রফিকুল করিম। বাকি টাকাটা আমি এদিক সেদিক করে ম্যানেজ করেছি। ‘চাকা’ সিনেমাটি চলেছে ভালোই। টাকা পুরো ওঠেনি। তবে আমি এটার জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলাম। তো সেটার থেকে আমি পেয়েছিলাম প্রায় ৯ লাখ টাকা। সুতরাং টাকাটা ওই দিক থেকে উঠে গেছে। চাকা প্রথমে অ্যাওয়ার্ড পেল জার্মানির ম্যানহালে ১৯৯৩ সালে। ম্যানহাল ফেস্টিভ্যালে ২ টা অ্যাওয়ার্ড পেল। ৩ টা ফিল্ম জুরি অ্যাওয়ার্ড পেল। তারপর ৯৪ সালে ফ্রান্সের ৩টি অ্যাওয়ার্ড পেল। একসঙ্গে ৩টি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। কিন্তু একসঙ্গে এক ছবিকে এভাবে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় না। চাকার বেলায় সেটাই দেওয়া হয়েছিল। তো সেখানে অনেক ভালো ভালো ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। ইরানের ছবি হয়েছিল। কিন্তু আমার এত নরমাল একটা ছবি পুরস্কার পেল। আমি ডিনারে আনোয়ার হোসেনকে (ক্যামেরাম্যান, উনি তখন ফ্রান্সে থাকেন) ডিনারের সময় বললাম ওখানে অ্যাওয়ার্ড পাওয়া ছবি এসেও অ্যাওয়ার্ড পায়নি। তারা বলল এই ছবিটাই আমরা টেকনিক্যাল কোয়ালিটি কী সেটা দেখিনি, দেখেছি ছবির ভাবটা। তো অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর দেখলাম ছবিটি তখন আলোচিত হওয়া শুরু করলো। এর আগে কিন্তু এটা ছবি হিসেবে তেমন কোন মূল্যায়ন হয়নি। আমি যখন ‘চাকা’ সিনেমাটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডে জমা দিতে গেলাম। তখন তারা বলল তোমার ছবিটি আমরা শর্টফিল্প হিসেবে জমা দিতে পারি। আমি বললাম কেন? শর্টফিল্ম হিসেবে জমা দেব কেন? আমার এটা ৪টা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। জার্মানিতে ফিচার ফিল্ম হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে। ওদের ওখানে ১ ঘন্টার ওপরে হলে ফিচার ফিল্ম হিসেবে ধরে। কিন্তু আমাদের এখানে এটাকে শর্টফিল্ম হিসেবে ধরা হবে। আমি ছবিটি জমা দিলাম না। আর বললাম আমি ছবিটি দিবই না বলে জমা দিলাম না।
চলচ্চিত্রনিয়েসামনেরদিনেআপনারপরিকল্পনাকী?
সব সময় চেষ্টা থাকে ভালো ফিল্ম তৈরি করার, এই চেষ্টাটা ভবিষ্যতেও থাকবে। আমরা চাই ভালো সিনেমা তৈরি হোক। ভালো সিনেমা তৈরি হলেই কেবল দর্শক হলে ফিরবে।