সড়ক দুর্ঘটনা পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলারই একটি চিত্র বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার। পরিবহনখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ট্রান্সপোর্ট কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেছেন এই বিশেষজ্ঞ। বুয়েটের এআরআইয়ে নিজ দপ্তরে বসে এই সময়-এর সঙ্গে একান্ত আলাপে এসব কথা বলেন ড. মাহবুব আলম তালুকদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন মাহী। সড়ক দুর্ঘটনা তো বাড়ছেই...
দুর্ঘটনা কমার কোনো কারণ নেই। যেভাবে সড়কে পরিবহনগুলোর বিশৃঙ্খলা চলছে তাতে দিনদিন দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে। সেটা কেন?
আমাদের দেশে পরিবহন খাতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। কতগুলো পরিবহন কোম্পানি আছে তারও ঠিক নেই। গাড়িগুলো লক্কড়ঝক্কড়। ইচ্ছাধীন চলছে। যেকোনো সড়কে ঢুকে পড়ছে এসব গাড়ি। বিশ্বের কোথাও এই পদ্ধতি নেই। ফলে দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশই তো অতিরিক্ত গতির কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ অতিরিক্ত গতি। তবে একমাত্র কারণ নয়। যখন পুরো সিস্টেমেই গোলমাল তখন শুধু অতিরিক্ত গতি নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। সিস্টেম যখন ঠিক হবে তখন অতিরিক্ত গতি কোনো সমস্যা নয়। অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নেই?
অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে ¯িপড মিটার আছে। সেটি কিন্তু প্রয়োগ হচ্ছে না। আর এটি প্রয়োগ করলেই যে সব ঠিক হয়ে যাবে তাও নয়। তবে ¯িপড মিটারের যথাযথ ব্যবহার করে গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গতি নিয়ন্ত্রণে আসলে যে দুর্ঘটনা বন্ধ হয় তা কিন্তু নয়। সব কিছুর মূলে সিস্টেম ঠিক করতে হবে। সিস্টেম বলতে কী বুঝাচ্ছেন?
আমাদের দেশে সড়ক পরিবহনের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় নেই। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পরিবহন খাতের জন্য আলাদা মন্ত্রী রয়েছে। এখানে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় জড়িত। সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, বন মন্ত্রণালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় জড়িত। পরিবহন কোম্পানিগুলোর মালিকও অনেক। তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তারা সবাই অতিরিক্ত মুনাফা খাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সবকটির নিয়ন্ত্রণ যদি একজনের কাছে থাকে, আর সেটির নিয়ন্ত্রণ যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে করা হয় তাহলে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে বাধ্য। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী তো বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, দেখুন রাস্তাঘাটের সমস্যা ও দুর্ঘটনা বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে সমাধান করা যায় না। বৈজ্ঞানিক উপায় এসব সমাধান করতে হবে। বৈজ্ঞানিক সমাধানটা আসলে কী?
বৈজ্ঞানিক সমাধান বলতে গবেষণাধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে এর মধ্যে রয়েছে লেন মেনে গাড়ি চালানো, মহাসড়কগুলোতে লেন বাড়ানো। নির্দিষ্ট গাড়িগুলো যদি নির্দিষ্ট লেনে চলে তাহলে অনেক দুর্ঘটনা কমে আসবে। এছাড়া ডিভাইডার নির্মাণ। এই দুটি জিনিস ঠিক হলে ওভারটেকিং করতে গিয়ে যে দুর্ঘটনা হয় সেটি আর হবে না। দ্বিতীয়ত, পথচারী সচেতনতা বাড়ানো। পথচারীর সচেতনতা বাড়ানো খুবই জরুরি। কারণ মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৪২ শতাংশ মারা যায় পথচারী। আর গ্রামাঞ্চলে দুর্ঘটনায় ৫২ শতাংশ পথচারী মারা যায়।
পথচারী সচেতনতা বাড়ানো গেলে গড়ে ৫০ শতাংশ মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে। ঢাকা সিটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ শতাংশ পথচারী মারা যায়। তৃতীয়ত, মহাপরিকল্পনা গ্রহণ। পরিবহন খাত নিয়ে মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। সব পরিবহন মালিকদের নিয়ে একটি সমিতি গঠন করতে হবে। এই সমিতি ঠিক করবে কোন রুটে কোন গাড়ি যাবে। একটি রুটে একটি পরিবহনের গাড়ি চলবে। তাহলে আর প্রতিযোগিতা হবে না। ফলে দুর্ঘটনা কমে যাবে।
চতুর্থত, ট্রান্সপোর্ট কমিশন গঠন। পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণে ট্রান্সপোর্ট কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশন শুধু পরিবহন খাত দেখবে। এই কমিশন নিয়ন্ত্রিত হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। তাহলে আর অন্য কেউ পরিবহন খাত নিয়ে রাজনীতি করতে পারবে না। পঞ্চমত, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। সবকিছুর মধ্যেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জবাবদিহিতা না থাকলে সিস্টেম লস কমবে না। জবাবহিদিতার মধ্যেই স্বচ্ছতা তৈরি হবে। সড়ক ও পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে।