ইলিয়াস কাঞ্চন- চিত্রনায়ক হিসেবে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুতে সড়ক নিরাপদ করার সামাজিক আন্দোলনে একপর্যায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বেদের মেয়ে জোছনাখ্যাত বড়পর্দা কাঁপানো এই তারকা। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হিসেবে এখন দারুণ সক্রিয়। শুধু পর্দার নায়ক নয়, সড়কের নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের চিন্তাভাবনাও উঠে এসেছে ঢাকাটাইমসের আলাপে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে এর দ্বিতীয় পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ ঋয়াদ ও শেখ সাইফ নিরাপদ সড়ক চাই নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কি ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
আপনারা জানেন, ২০১২ সালে আমার একটি প্রোগ্রাম করার ঠিক দুই দিন পর পরিবহনের লোকেরা সেখানে একটি প্রোগ্রাম করল। সেখানে তারা আমার ছবির মধ্যে জুতার মালা পরাল। মানুষের জীবন বাঁচাতে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে সামাজিক আন্দোলন করছি। এর পুরস্কারই এসব। কারণ সরকার থেকে তো আমি কোনো স্বীকৃতি বা পুরস্কার পাইনি। কত মানুষ সামাজিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক পাচ্ছে, স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছে, আমাকে দেওয়া হয়েছে জুতার মালা। আমি পেয়েছি জুতার মালা। আপনার স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় সেটার কি মামলা হয়েছিল?
না আমি সেটার মামলা করিনি। মামলা করিনি এই জন্য যে, মামলা করার আগে আমি জিজ্ঞেস করেছি কি ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে? আমাকে বলা হয়েছে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ শাস্তি হলো তিন বছর। যার বিরুদ্ধে মামলা করব তাকে এরেস্ট করা যাবে না। এরেস্ট করলেও ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে জামিন দিতে হবে। তাছাড়া প্রথম কেসটা হবে লওয়ার কোর্টে পরে হাইকোর্ট, তারপর সুপ্রিম কোর্ট। আমার তখনকার ক্রেজ এর কথা আপনার জানেন। এটা নিয়ে এত দৌড়ানোর সময় কোথায়। তাছাড়া অনেক সময় নষ্ট করে রায় পেতে পেতে লেগে যায় বহু বছর। আমি একজনকে জানি যার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, সেই রায় নিষ্পত্তি হয় ২৭ বছর পর। এটা কি সম্ভব বলেন? আমি সব জেনে আর সেদিকে আগাইনি। তাছাড়া হাজতের বছর ১০ মাসে, তিন বছর মানে আড়াই বছর। এই হলো আমাদের দেশের পরিস্থিতি। এক সময়ের জনপ্রিয় নায়ক, অনেক ভক্ত, সামাজিক আন্দোলনে করতে এসে সেই জনপ্রিয়তা কাজে লেগেছে কি?
অবশ্যই কাজে লেগেছে। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। মানুষ আমার এই আন্দোলনটাকে গ্রহণ করেছে। মানুষের ভালোবাসা আছে বলেই এখনও কাজ করে যেতে পারছি। না হলে পারতাম না। এবার চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গে আসি। বেদের মেয়ে জোসনা দিয়ে শুরু হোক। এই সিনেমায় কিভাবে যুক্ত হয়েছিলেন?
সেই সময়ে আমি প্রচণ্ডরকম ব্যস্ত নায়ক। তারা আমাকে নিয়ে বেদের মেয়ে জোসনা সিনেমাটা বানাতেই ভয় পাচ্ছিল। আমি তাদের সিডিউল দিতে পারবো কি না? পাশাপাশি এই সিনেমার যে নায়িকা (অঞ্জু ঘোষ) ছিল তার টানা ১৮টি সিনেমা সুপার ফ্লপ। পরপর ১৮টি সিনেমা ফ্লপ হওয়ার পর এই সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার সময় কেউ আর হল দিতে চাইছিল না। এটা কি নায়িকার কারণে?
হ্যা, হল মালিকরা বললো, যার পরপর ১৮টি সিনেমা ফ্লপ, তার সিনেমা আর কি হবে? ফলে প্রডিউসারের সঙ্গে হল মালিকদের একটা গণ্ডগোল লেগে গেল। চট্টগ্রামের যে হল মালিকদের সঙ্গে প্রডিউসারের কথা হয়েছিল, তারা পরে মানা করে দিয়েছে। প্রডিউসার আব্বাস সাহেব যখন বসে কথা বলছিলেন হল মালিকদের সঙ্গে, ওরা ছবি চালাতে রাজি না হওয়ায় উনি ঘুষি দিয়ে টেবিল ভেঙ্গে ফেলেছেন। এই রকম একটি অবস্থার মধ্য দিয়ে সিনেমাটি রিলিজ হলো খুলনায়। এর পাশাপাশি যশোরসহ আরও বেশ কয়েকটি হলে সিনেমা মুক্তি পায়। প্রথম তিন দিন কোনো খবরই ছিল না। পরে দর্শক যারা দেখেছিল তাদের প্রচারে দর্শক বাড়তে থাকলো। যা ফ্লপ হওয়ার আশঙ্কা, সেই সিনেমা এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে হিট ছবি। কী বলবেন?
হ্যা, সেটা আরও মজার ঘটনা। হল মালিকরা ছবির প্রিন্ট দিতে চাচ্ছে না। যতদিন প্রদর্শনের চুক্তি আছে তারচেয়ে বেশি দিন তারা জোর করে প্রদর্শন করছে। একসময় প্রডিউসার পুলিশ দিয়ে এসব প্রিন্ট ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হলো। সাড়া দেশে একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল। একটা সিনেমা নিয়ে এত সরব হলো দর্শক, যা ভাবা যায় না।
আমাদের দেশের রহিম রূপবান, সাত ভাই চম্পা, সুজন সখী, বেদের মেয়ে জোসনা, কিংবা এই সময়ের খায়রুন সুন্দরী, মনপুরা- এই সিনেমাগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সারা বছর শহুরে গল্পের ছবি হলেও রূপকথা বা গ্রামীণ আবহের ছবি সুপার-ডুপার হিট।
এই সিনেমাগুলো দেখবেন প্রতিটি প্রেমের সিনেমা। এই প্রেমের গল্পগুলোকে এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হতো প্রতিটি গল্পই সফলতা পেত। আর আনেক সুন্দর সুন্দর গান থাকতো। যে গানগুলো দর্শকদের মুগ্ধ করতো। দর্শকরা পাগল হয়ে সেসব গান শুনত। এই কারণেই ছবিগুলো হিট হতো। আর গল্প নির্ভর ছবি ছিল সেগুলো। ফলে মানুষের খুব কাছে চলে গেছে সিনেমাগুলো। প্রযুক্তির অগ্রগতি হলেও বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন হারিয়ে গেছে, এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?
সেই পাকিস্তান পিরিয়ড থেকে এদেশের সিনেমাকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়নি। শুধু বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ছিল। উনার কারণেই কিন্তু এফডিসি হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বলেছিল পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) সিনেমা বানানোর পরিবেশ নাই। এখানে ধুলা বাালু, সেলুলয়েডে ধুলা লাগবে, তাই এখানে সিনেমা হবে না। তখনকার সংসদে (গণপরিষদ) অনেক ফাইট করে তিনি এখানে এফডিসি বানালেন। এদেশে বঙ্গবন্ধু একটি অর্ডিনেন্স জারি করলেন, যেটি ছিল উপমহদেশের কোনো ছবি এদেশে তাদের ভাষায় আসতে পারবে না। যদি আসতে হয় সেটি আসতে হবে ইংরেজিতে। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষার প্রতি তার যে ভালোবাসা এবং একই সঙ্গে ইংরেজিতে সিনেমা আসলে ছেলেমেয়েরা শিখিতে পারবে সেটিও তিনি ভেবেছেন। ইংরেজি শিখলে আমাদের কাজে আসবে এটিও ভাবলেন। হিন্দি শিখে আমাদের কোনো উপকারে আসবে না, উর্দু শিখলে আমাদের কোন উপকারে আসবে না। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উন্মুক্ত বাণিজ্য নীতিতে তারা কিন্তু এখন সিনেমা আমদানি করছে, বঙ্গবন্ধুর সেই অর্ডিন্যান্সকে ভায়োলেট করে। এতে বঙ্গবন্ধুর করা আইনটির প্রতি কিন্তু তারা শ্রদ্ধা দেখাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তারা যদি শ্রদ্ধাশীল হতো, চলচ্চিত্রের প্রতি তাদের ভালবাসা থাকতো, তাহলে তারা এটা করতে পারতো না। চলচ্চিত্রের এই অবস্থাকে কি অভিভাবকহীনতা বলবেন?
অনেকটা কিন্তু সেরকমই। পাকিস্তান পিরিয়ড থেকেই আমাদের আমাদের চলচ্চিত্র অভিভাবকহীন অবস্থায় চলছে। বঙ্গবন্ধুর সময় বাদে পাকিস্তান পিরিয়ড কিংবা বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী সময়ে সরকারি কোনো উদ্যোগ ছিল না চলচ্চিত্রের জন্য। কোনো অভিভাবক ছিলো না এই শিল্প রক্ষার। তাহলে একটা দেশের চলচ্চিত্র দাঁড়াবে কি করে? বঙ্গবন্ধুর সময়ে সবাই পরিশ্রম করেছে। তারপর কোনো সরকার সেভাবে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। সে সময় চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অভিনয়শিল্পীদের ভূমিকা কেমন ছিলো?
আমরাও দিনের পর দিন পরিশ্রম করেছি সে সময়। বিশেষ করে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট থেকে কালার এ আসার জন্য আমরা প্রডিউসার এবং পরিচালককে বুঝিয়েছি। একটি শট যদি চার বা পাঁচবার এনজি হয়ে যায়, তাহলে ফিল্মের কস্ট বেড়ে যাবে, এজন্য আমরা স্যুটিংয়ের আগে প্রচুর রিহার্সেল করতাম যেন একটিও এনজি শট না হয়। এভাবে করাতে কিন্তু ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট থেকে কালারে ছবি চলে আসলো। এই চেষ্টাটা তখন প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রী করেছে। কিন্তু যারা কষ্ট করেছে তাদের কি সেই মূল্যায়নটা হয়েছে? এমনও হয়েছে আমরা টাকাও নেইনি, কিন্তু তাও অভিনয় করেছি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয় অভিনয়শিল্পীরা। পাশের দেশ ভারতেও সেটা হয়, কিন্তু আমাদের দেশে কি সেটা হয়? হয় না। আপনি বিশ্ববাজার ধরতে চান পৃথিবীর বুকে নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চান, কিন্তু আপনি তাকে সেই জায়গাটুকু দেবেন না, সেই মর্জাদাটুকু দেবেন না, তাহলে চলচ্চিত্র দাঁড়াবে কিভাবে? দর্শক এবং হল দুটোই কমছে, এর কারণ কী?
আগে জমির কাঠা ছিলো পাঁচ হাজার টাকা, এখন সেটা বহুগুণ বেড়েছে। একটি হল করলে আপনার লসও হতে পারে আবার লাভও হতে পারে। কিন্তু যদি সেখানে মার্কেট করেন একবারেই কোটি কোটি টাকা আপনি পেয়ে যাবেন। আর রিস্কও নেই, তাহলে কে হল করতে যাবে? তাই সবাই হল ভেঙ্গে মাল্টিস্টোর করছে। সেখানে ব্যবসা হচ্ছে। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে হলের জায়গায় মার্কেট বা অন্য কিছু করলেও সিনেমা হলের জন্য জায়গা নিশ্চিত করার আইন আছে। আপনি হলকে একবারে ডিমোলিশ করে দিয়ে কিছু করতে পারবেন না। আমাদের দেশে সেই আইন নেই।
আগামীকাল তৃতীয় ও শেষ পর্ব : শাকিব খান সবদিক থেকেই বেটার