বিসিবি এখনো ঢাকা ক্রিকেট বোর্ড হয়েই আছে : উৎপল শুভ্র
প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৮:২০:২৩
বিসিবি এখনো ঢাকা ক্রিকেট বোর্ড হয়েই আছে : উৎপল শুভ্র
ক্রীড়া সাংবাদিকদের মধ্য থেকে একজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে, তিনি কে? উৎপল শুভ্রর জন্ম না হলে এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই ভাবাতো, দু-চারজনের ছোট একটা তালিকা হতে পারত। সাবলীল উপস্থাপনা, জাদুকরী লেখনী, স্বকীয়তা আর নির্ভীক সাংবাদিকতা দিয়ে তিনি নিজেকে অভাবনীয় এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যার ধারেকাছে নেই অন্য কেউ। ক্রীড়া সাংবাদিকতা যদি সাহিত্য হয়, উৎপল শুভ্র তবে হুমায়ূন আহমেদ। আলাপচারিতার তৃতীয় ও শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো আজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে কতটা পেশাদার মনে হয় আপনার?
আগের চেয়ে অনেক ভালো। কিন্তু সর্বোপরি বাংলাদেশের তো নিজস্ব একটা নিয়ম আছে, তাই নয়? আমরা নিজের নিয়মেই চলি, চলতে পছন্দ করি। এখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা খুব বেশি। দেশের সর্বোচ্চ অবস্থা থেকে যদি আস্তে আস্তে নিচে নামেন, পরিবার পর্যন্ত দেখবেন, সবখানেই ব্যক্তিবিশেষের প্রাধান্য। হয়ত আমিও তাই করি। ধরেন, ক্রিকেট বোর্ডের ছাদ দিয়ে পানি পড়ছে, এ নিয়ে যদি সাংবাদিকরা সিইও বা অন্য কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেন, তাহলে উনি হয়ত বলবেন, প্রেসিডেন্ট বাইরে আছেন, উনি আসুক তারপর এ ব্যাপারে বলবেন। এই বিষয়গুলো তো আছেই। সবচেয়ে যেটা আপত্তিকর তা হলো, ক্রিকেট বোর্ড এখনো ঢাকা ক্রিকেট বোর্ড হয়েই আছে। এটা খুবই আপত্তিকর। এখনো কেন একটা ছেলেকে মিনিমাম একটা পর্যায়ে খেলতে ঢাকায় আসতে হয়? নোয়াখালীর ছেলে কেন নোয়াখালীতে খেলবে না? সে নোয়াখালী জেলায় খেলবে। বিভাগে খেলবে। তারপর সে একসময় ঢাকায় আসবে।
এই দীর্ঘ সময়ে অবকাঠামোগত উন্নতি কতটা হয়েছে বলে মনে করেন?
না, কিসের অবকাঠামো? কোথায় অবকাঠামো? আমরা বড় বড় কথা বলি মিরপুর নিয়ে। মিরপুরের মতো মাঠ, ইনডোর তো অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার রাস্তার কিনারে কিনারে। তারপরও আমরা লাকি যে, আমরা ওয়ানডেতে জিতি। এটার কারণ, আমাদের ৫, ৬, ৭ জন ক্রিকেটার একশ দেড়শটা ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে। তামিম, মুশফিক, সাকিব, মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহদের একটা গ্রুপ অব ক্রিকেটার দাঁড়িয়ে গেছে, যারা খেলা বোঝে। কেউ ৮ বছর কেউ ১০ বছর ধরে খেলছে। কিন্তু আমাদের যা সিস্টেম তাতে আপনি গ্যারান্টি দিতে পারেন না যে, ৫ বছর পর কী হবে। আর যেটা বললাম, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে ঢাকা ক্রিকেট বোর্ড থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্রিকেট কূটনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিসিবির ক্রিকেট কূটনীতির বিপরীতে কত মার্ক দিবেন?
আমরা তেমন কিছু দেখি না। এমন না যে, যে জিনিসগুলো পাওয়ার কথা ছিল সেগুলো আমরা পেয়ে গেছি। সত্যিকার অর্থে বেশি মার্ক দেওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। যে ক্রিকেট কূটনীতিটা করে বা করবে তার ব্যক্তিগত ক্ষমতা, যোগ্যতা, রিলেশন রাখার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আমাদের প্রেসিডেন্ট নাকি আইসিসির অনেক কমিটির সদস্য। নিশ্চয়ই আইসিসিতে ওনার প্রভাব আছে বলে আমরা আশা করি। কিন্তু সেটার ফল যদি আমরা দেখতে পারতাম তাহলে বুঝতাম যেমন বাংলাদেশ একটা আনশিডিউল ট্যুর পেয়েছে। দ্বিস্তরবিশিষ্ট টেস্ট বা মাঝেমধ্যে বাংলাদেশকে নামিয়ে দেওয়ার কথা যখন ওঠে তখন যদি কোনো দেশকে পাশে পাওয়া যেত, তখন বলা যেত। কিন্তু বাংলাদেশ বলেই হয়ত কোনো দেশ পাশে এসে দাঁড়ায় না। আজ ভারত দ্বিস্তরের বিরোধিতা করছে, কারণ ওরা মনে করছে এটা ক্রিকেটের জন্য ভালো নয়। আমাদের প্রতি অন্যায় হচ্ছে বা জিম্বাবুয়ের প্রতি অন্যায় হচ্ছে, এজন্য ভারত ওই অবস্থান নেয়নি।
ইন্ডিয়াতে ট্যুর না পাওয়াকে অনেকেই বিসিবির কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখে থাকেন?
এটা নিয়ে অকারণে এত কথা বলার কিছু নেই। ইন্ডিয়া ট্যুর আদৌ কি আমরা পেতে চেয়েছি? এই জিনিসটা বুঝতে হবে। বাংলাদেশ ভারতে গেলে কোনো লাভ নেই। আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের কাউকে কি শুনেছেন এই নিয়ে কখনো কড়া কথা বলতে? অযথা আমরা কেন লাফাই? বরং ভারত এখানে এলে আমাদের লাভ। দেখেন, তারা তো নিয়মিতই এখানে আসছে। ২০০৪ , ২০০৭, ২০১০ সালে তারা এসেছে। তারা এলেই আমাদের লাভ। হ্যাঁ, একটা ব্যাপার হলো, পারস্পরিক সম্মানের ওই ব্যাপারটা। কিন্তু এ নিয়ে আমরা যতটা চিন্তিত, বিসিবি সেটা নাও করতে পারে। ভেতরের খবর আমি সঠিক বলতে পারব না, তবে আমার ধারণা, গত ১০-১৫ বছরে হয়ত একাধিকবার ঐকমত্য হয়েছে, ওরা বাংলাদেশে আসবে। আমরাও ওখানে যাব। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডই হয়ত বলেছে, ওকে ওকে, তোমরাই আসো। কারণ তারা এলে বাংলাদেশের আর্থিক লাভ। জিনিসটা তো এমনও হতে পারে। এটা হয়ত কোনোদিন প্রকাশ হবে না।
কিছুদিন আগে বিসিবি প্রেসিডেন্টের সংবাদ সম্মেলনে চার শীর্ষস্থানীয় মিডিয়াকে প্রথম দিকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি (যদিও পরে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল)। একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে ঘটনাটা আপনাকে কতটা আহত করেছিল?
আমি বিস্মিত এবং উদ্বিগ্ন। আমি তখনও ক্রিকইনফোর সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় এটা বলেছিলাম। বিস্মিত কারণ, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ক্রিকেটে কখনো ঘটেনি। আর উদ্বিগ্নের কারণ, এটা প্রেস ফ্রিডমের ওপর আঘাত। এখন বোর্ড সভাপতি উনি। ওনার আগেও একজন ছিলেন। পরেও আরেকজন আসবেন। তারা আসবেন- যাবেন। আমরা তো সবার সময়েই ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব। কেউ যদি আজ ক্রিকেটে বিরাট শুভাকাক্সক্ষী হয়ে যায়, আর অমুক ক্রিকেটের শত্রু, অমুক ক্রিকেটের ভালো চায়, অমুক মন্দ চায় তাহলে সেটা দুঃখজনক। আসলে মিডিয়া কখনো কারো শক্র হওয়ার বা কারো কাছে ভালো হওয়ার মিশন নিয়ে আসে না। আমি মনে করি, এগুলোর ফল খুব ভালো হয় না। মিডিয়ার কাজ হচ্ছে, ভুলগুলো তুলে ধরা, বিচার বিশ্লেষণ করা। কথা হলো, সঠিক লিখেছি না বেঠিক লেখেছি। বিরুদ্ধে আর পক্ষে বলে কোনো কথা হতে পারে না। এখন সব ঘটনাই মানুষ চেনে ফেলে। আপনি যখন ঘটনা লিখতে যাবেন তখন কারো পছন্দ হবে, কারো হবে না। কিন্তু এটার পথ কখনই এটা হবে না যে, আপনি যুদ্ধ ঘোষণা করবেন।
আশরাফুল তার আন্তর্জাতিক অংশটুকুতে কি করেছে, আমি মনে করি সেটারও তাড়াতাড়ি তদন্ত হওয়া উচিৎ। আশরাফুলের যে শাস্তি হয়েছে, সেটা বিপিএলের জন্য। তার সঙ্গে বাকি কারা কারা জড়িত, যাদের সে নাম বলেছে, তাদেরও বিচার হওয়া উচিৎ। আর যদি আশরাফুল মিথ্যা বলে থাকে, কেন সে মিথ্যা বললো, এজন্য তার অন্য বিচার হওয়া উচিৎ। বিসিবির নিজের দায়িত্ব থেকেই এটা করা উচিত।
আপনি মানুষ হিসেবে কেমন? ইমোশনাল না বাস্তববাদী?
মিক্সড। কখনো ইমোশনাল, কখনো বাস্তববাদী। অলওয়েজ গিভেন বাই হার্ট। এটা একটা সমস্যাই। সবসময় নিজের টার্মে চলেছি। কোনো দিন হিসাব করেনি। হিসাব করতেও হয়নি। নিজের কাছে যেটা ঠিক মনে হয়েছে, সেটাই করেছি। এটা করতে গিয়ে প্রচুর ভুল হয়েছে। আমার চেয়ে বেশি সরি মনে হয় পৃথিবীতে কেউ বলেনি।
জীবনকে কীভাবে দেখেন?
জীবন মজা। জীবন একটা লম্বা জার্নি। উত্থান-পতন, অনেক চড়াই-উৎরাই।
মৃত্যু নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
মৃত্যু ভয় খুব একটা নেই। বাকি জীবনটা খুব সুখের হবে, এটা ভাবি না। অসুখ, বিসুখ আছে। এখন যদি মৃত্যু আসে আমি প্রস্তুত।