সালাউদ্দিনের জন্য কাজটা কঠিন হয়ে গেছে : উৎপল শুভ্র
ক্রীড়া সাংবাদিকদের মধ্য থেকে একজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে, তিনি কে? উৎপল শুভ্রর জন্ম না হলে এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই ভাবাতো, দু-চারজনের ছোট একটা তালিকা হতে পারত। সাবলীল উপস্থাপনা, জাদুকরী লেখনী, স্বকীয়তা আর নির্ভীক সাংবাদিকতা দিয়ে তিনি নিজেকে অভাবনীয় এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যার ধারেকাছে নেই অন্য কেউ। ক্রীড়া সাংবাদিকতা যদি সাহিত্য হয়, উৎপল শুভ্র তবে হুমায়ূন আহমেদ। আলাপচারিতার দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো আজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন।
অনেকেই স্পোর্টস এডিটর থেকে আরো বড় দায়িত্বে গেছেন। কিন্তু আপনি যাননি। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো ইচ্ছা...?
না। বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের সুযোগ আমার এসেছে। আমি যাইনি।
গ্রহণ করলেন না কেন?
স্পোর্টসের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। বলতে পারেন, এটা কমফোর্ট জোনে থাকা। একদিকে এটা অবশ্য নেগেটিভ। আমি আসলে সাংবাদিকই হতে চাইনি কখনো। খেলা পছন্দ করতাম, খেলা নিয়ে লিখতাম, ঘটনাচক্রে খেলার সাংবাদিকতায় আসা। এ জন্যই এটা আমি এনজয় করি। কিন্তু সাংবাদিকতার আরো বড় ক্ষেত্র অনেক কঠিন জায়গা। সেখানে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ ওটা আমি এনজয় করি না। আপনি যেটা এনজয় করেন না সেটা গ্রহণ করতে পারেন না। আমিও তাই করেছি। আমার সম্পাদক আমাকে এ ধরনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, সাংবাদিকতা করতে এখানে আসিনি। তিনি অবাক হলেন। বললেন, সাংবাদিকতা করতে আসোনি মানে? বলেছিলাম, সাংবাদিকতা করছি ঘটনাচক্রে কিন্তু সেটা খেলার বাইরে কঠিন। অনেকেই মনে করেন, ওখানে গেলে আমি বিরাট কিছু করে ফেলতাম। এটা ভুল ধারণাও হতে পারে।
কঠিন কেন?
ওটা অনেক কঠিন জায়গা। কারণ ওখানে প্রধানমন্ত্রী জড়িত, রাষ্ট্রপতি জড়িত। আরো অনেক বড় বড় ব্যাপার জড়িত। আর এখানে তো একটু তামিম রাগ করল, মাশরাফি অভিমান করল, আশরাফুলের মনে হলো তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। কিন্তু ওখানে চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়। টেনশন বড়। অবশ্য প্রাপ্তিও বড়।
আপনার অসাধারণ লেখা আরো অসাধারণ করে তুলে পরিসংখ্যানের চমৎকার ব্যবহার। অনেকেই বলেন, উৎপল শুভ্র জীবন্ত ডিকশনারি...।
এখন তো এত মনে রাখতে হয় না। এক ক্লিকেই সব চোখের সামনে হাজির। সত্যিকারের কঠিন ছিল ’৯১ থেকে ’৯৪ পর্যন্ত। এমনকি ২০০৫-০৬ সাল পর্যন্তও কঠিন ছিল। মনে পড়ে, ট্যুর শেষে দেশের বাইরে থেকে যখন ফিরতাম কাঁধে দাগ হয়ে যেত। কারণ আমার ব্যাগের মধ্যে নানা পরিসংখ্যানের বই যেগুলো ব্যাগটাকে অনেক ভারী করে তুলত। একটা দিক ভালোই ছিল, সবাই এই কষ্টটা করতে রাজি ছিল না। আমি যাই দিতাম, সেটা পাঠকের কাছে এক্সট্রা মনে হতো। এখন তো সবার হাতে হাতেই পরিসংখ্যান। তখন আসলেই অনেক কঠিন ছিল। ব্রাডম্যানের ৯৯.৯ ব্যাটিং গড়, ২৯টি সেঞ্চুরি বা ৫২ টেস্টে ৮০ ইনিংস। এগুলো মনে রাখার মানে এই নয় যে, পরীক্ষার মতো করে মুখস্থ করতে হবে। আপনি যদি একটা জিনিস অসংখ্য বার পড়েন তাহলে সেটা মাথায় এসে যায়। কিছু লেখা আছে, যেমন বিদেশে গিয়ে এটা কড়চা লিখলাম সেটা কীভাবে লিখলাম, কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু এর বাইরে লেখাটা আমার কাছে অনেক কষ্টের ব্যাপার। আমার কথা হলো, ওয়ার্ক লাইক এ রিপোর্টার।
অসংখ্য বড় টুর্নামেন্ট, বিশ্বকাপ, গেমস কাভার করেছেন। ঘুরেছেন বিশ্বব্যাপী। এর মধ্যে আপনার স্মরণীয় ট্যুর কোনটি?
আসলে এটা বলা কঠিন। আমি প্রথম টেস্ট কাভার করেছি ’৯৩ সালে কলকাতায়। মাসির বাসায় ছিলাম বলে আমার কাছে সেটা অবশ্য পুরোপুরি ট্যুর মনে হয়নি। তারপর মেজর ট্যুর ছিল ’৯৪ সালে শ্রীলঙ্কায় সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড ট্রফি। অফিস থেকে রাজি ছিল না। বলেছিলাম, ২৫ হাজার টাকা দেন, আমি টুর্নামেন্টটা কাভার করি। অফিস থেকে বলা হয়েছিল, ওখানে গিয়ে কী করবা? আমি শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেটা ছিল ২২ দিনের টুর্নামেন্ট। তখন সার্কের একটি টিকিট ম্যানেজ করেছিলাম ৩০ শতাংশ ছাড়ে। ঢাকা থেকে কলকাতায় গেলাম প্লেনে। কলকাতা থেকে চেন্নাই ট্রেনে করে। ওখান থেকে প্লেনে গেলাম কলম্বোতে। ওই ২২ দিন খুবই একটা পচা হোটেলে ছিলাম। এই ২২ দিনে এববারও পেটভরে খেতে পারিনি। শ্রীলঙ্কায় সাধারণ মানের যে হোটেল, সেখানে রান্না হয় নারকেল তেলে। যে খাবার আমি খেতে পারি না। যেগুলো একটু ভালো মানের হোটেল সেখানে খাওয়ার সামর্থ্য আমার ছিল না। ঢাকা শহরে যেটা করেনি সেটাও করেছি কলম্বোয়। আমি বাসে ঝুলে চলাচল করেছি। সে কী কষ্ট! কিন্তু ওই সফরে আমি প্রচুর কাজ করেছি। ২০টা, ২৫টা বা ৩০টার মতো সাক্ষাৎকার নিয়েছি। ওয়াসিম আকরামের সামনে গিয়ে কাঁপছি, কপিল দেবের ইন্টারভিউ নিয়েছি, আজহার উদ্দিনের করছি। এখানে ছুটছি, ওখানে ছুটছি। আমার প্রথম বই ১৬ তারকার মুখোমুখি ওই ট্যুর থেকেই। অফিস থেকে আর কত টাকাই দেওয়া হয়েছিল। ওটা ছিল আমার জন্য খুব কঠিন ট্যুর। জেদ ঠিক না, আমার মধ্যে একটা নেশা ছিল, প্রচ- আগ্রহ ছিল। ওই যে একটা কথা উঠেছিল, আমি ওখানে গিয়ে কী করব, এই প্রশ্নটা আর ওঠেনি। বরং আমার এই ট্যুরের পর অন্য পত্রিকা থেকেও রিপোর্টার পাঠানো নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে তো অনেক ট্যুর আছে, যেমন বাংলাদেশ ভালো করেছে, এমন সব ট্যুর বা বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ কাভার করেছি দুটি, অলিম্পিক চারটি। সেগুলো আবার অন্য ব্যাপার। অলিম্পিক এত হিউজ, এত বর্ণিল ভাবা যায় না। এত জাতি, এত মানুষ। খেলার চেয়ে বড় ব্যাপার এটা।
আপনি তো অনেক কিংবদন্তি, গ্রেটদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যদি সেরা সাক্ষাৎকারটির কথা জানতে চাওয়া হয় তাহলে সেটা কোনটি?
আপনার ইন্টারভিউয়ের খুব নেশা আছে। আমি প্রচুর ইন্টারভিউ করেছি। এর মধ্যে একটা বা দুইটা বেছে নেওয়া খুবই কঠিন কাজ। আমার একটা বই আছে তার মুখে তারার কথা। ওখানকার ইন্টারভিউগুলো অনেক স্পেশাল। তবে ওই বইতে যে ইন্টারভিউটা নেই, সেটাকেই আমি এগিয়ে রাখতে চাই। ২০০৯ সালে গ্যারি সোবার্সের ইন্টারভিউ করেছিলাম। সোবার্স তখন বার্বাডোজের ট্যুরিজমের অ্যাম্বাসাডর। ওটার ওপর সে ইন্টারভিউ দেবে, ক্রিকেটার হিসেবে নয়। কিন্তু সেটা অগ্রাহ্য করে তাকে প্রশ্ন করায় তিনি অনেক রেগে গিয়েছিলেন। তিনি সারাক্ষণ আমাকে গালাগাল করেছিলেন। মনে হয়েছিল, আমাকে মারবে টারবে নাকি!
আপনি তো অনেক দেশে গিয়েছেন। নিশ্চয়ই অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে।
না, এটা হয়ত আমার একটা চারিত্রিক দুর্বলতা। আমার সঙ্গে কারো গভীর বন্ধুত্ব হয় না। এটা আমার ন্যাচারের সঙ্গে যায়। সারা বিশ্বে তো কিছু পরিচিত সাংবাদিক আছেই। কিন্তু গভীর বন্ধুত্ব আমার সঙ্গে যায় না। আর কাজের সময় আমি অন্য মুডে থাকি।
একসময় খুব বাজেভাবে হারত ক্রিকেট দল। প্রেসবক্সে বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে তখন নিজেকে কতটা অসহায় লাগত? এ নিয়ে বিব্রতকর বা কষ্টকর কোনো ঘটনা?
না, বিদেশি সাংবাদিকরা যে তিরস্কার করেছে, তা নয়। আমরা বরং সাংবাদিক হিসেবে বলেন, দর্শক হিসেবে বলেন, অসহিষ্ণু। ’৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানের পর ৪৭টি ম্যাচ বাংলাদেশ জিতেনি। ২টা ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে বলে হারেনি। আমি এগুলোর বেশির ভাগ কাভার করেছি। এর মধ্যে ১০০ রানে বাংলাদেশ অল আউট হয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে বড় রান তুলেছে প্রতিপক্ষরা। প্রথম তিন বলে হ্যাটট্রিক করে ফেলেছে তারা। এসব কেলেঙ্কারি তো ঘটেছেই। দল যখন এমন করে তখন আপনার কাছে মনে হতেই পারে, বুঝি বিদেশি সাংবাদিকরা আপনাকে নিয়ে তিরস্কার করছে। হ্যাঁ, দল ভালো করলে আপনার হাঁটাচলা, কনফিডেন্ট অন্য রকম হয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক। প্রায় ৫ বছরে ৪৭ ম্যাচ। যার ৪০টিই কাভার করেছি এবং দিনের পর দিন লিখে গেছি একই কথা। মানুষকে আশ্বাস দিয়ে গেছি। ক্যাপ্টেন বলেছেন, আমরা জয়ের জন্য নামব। কিন্তু তিনিও এটা বিশ্বাস করেননি। আমিও করিনি। তারপর কীভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মানুষকে আশা দিয়ে গেছি, সেটা আমার কাছে অবিশ্বাস্যই মনে হয় এখন। এখন তো ৬টার মধ্যে চারটা ম্যাচ না জিতলে অধৈর্য এসে যায়। আসলে এখনকার প্রজন্ম পরাজয়টা দেখেনি। তাই জয়ের মর্মটা তারা বুঝে না। আমি দুটোই দেখেছি। যেটা আমাকে সহজভাবে দেখার ক্ষমতা দিয়েছে। জয়-পরাজয় আমাকে এখন খুব আলোড়িত করে না।
একজন ক্রীড়া সাংবাদিককে ক্রিকেট, ফুটবলসহ আরো অনেক ইভেন্টে কাজ করতে হয়। আপনার প্রিয় ইভেন্ট কোনটা?
ক্রিকেট ইদানীং আমার কাছে বিরক্তি লাগে। টি-টোয়েন্টি, আইপিএল মিলে নতুন অস্থিরতা। ক্রিকেট কেমন যেন একটা সার্কাস হয়ে গেছে। আমি মূলত তিনটি খেলা ফলো করি। ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিকস। যদিও আমাদের দেশে অ্যাথলেটিকস সেভাবে হয় না। অ্যাথলেটিকস তো অসাধারণ জিনিস, বিদেশে গেলে বোঝা যায়। কিন্তু কাভার করার জন্য ফুটবলই বেটার। কারণ ফুটবল মাত্র দু ঘণ্টার খেলা। ক্রিকেট একটা লম্বা খেলা। ওয়ানডে বা টেস্টে কাভার করতে গেলে সকালে কাজ শুরু করতে হয়, আর লিখতে বসতে হয় ১০ ঘণ্টা পর। এটা খুব কঠিন। ক্লান্তিকর ব্যাপার।
বাংলাদেশ ক্রিকেট আজ ভালো অবস্থানে। ক্রিকেট এখানে আসার পেছনে সাংবাদিকদের অবদান কতটা বলে মনে করেন?
অনেক বড় অবদান। আমরা তখন আজকের কাগজে শুরু করেছিলাম, লোকাল ক্রিকেট মাঠে গিয়ে সিরিয়াসলি কাভার করা। একসময়ে ফুটবলের রমরমা অবস্থা ছিল। মাঝখানে ক্রিকেটারদের কেউ শতক করলে বা পাঁচ উইকেট পেলে নাকি ছবি নিয়ে মিডিয়া অফিসে যেতে হতো। মানে কাভার করার জন্য কোনো সাংবাদিক মাঠে যেতেন না। সেখান থেকে আস্তে আস্তে কাভারেজটা বেড়েছে। এরপর বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা, সব কিছু মিলেই এটা হয়েছে।। আমি মনে করি, খেলাটাকে ছড়িয়ে দেওয়া, মানুষের মধ্যে উন্মাদনা বইয়ে দেওয়ার জন্য মিডিয়ার ভূমিকা বিরাট। সেটা অবশ্য ক্রিকেট বোর্ডের লোকজন মাঝেমধ্যে ভুলে যান। ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই তখন ক্রিকেটের ‘সি’ও জানত কি না আমার সন্দেহ হয়। সে সময় মিডিয়াই ক্রিকেটকে এত জনপ্রিয় করে তুলেছে এবং মানুষের কাছে নিয়ে গেছে। আজ ক্রিকেটে এত টাকা, এত উন্মাদনা, এর মূলে তো মিডিয়া।
জাতি হিসেবে আমরা আবেগপ্রবণ। প্রেসবক্সেও সেটার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ দল যখন ভালো করে তখন সাংবাদিকরা পেশাদারিত্ব ভুলে খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। এটা কতটা ঠিক। যদিও আমরা দেখেছি, আপনি আবেগকে সবসময় ধরে রেখেছেন।
এটা মোটেও ঠিক নয়। একদম উচিত নয়। আমি খুব আপত্তি করি এতে। এর জন্য আমাদের দায় আছে, বিশেষ করে আমরা যারা সিনিয়র আছি। প্রেসবক্স হলো প্রফেশনালদের জায়গা। এখানে আচার আচরণে মিনিমাম কিছু এথিকস আছে সারা পৃথিবীতে। এই কথাগুলো নতুনদের বলবে কে? ওরা তো এসেই দেখেছে মিরপুর প্রেসবক্সে তালি দিতে হয়, চিৎকার পাড়তে হয়। যদি প্রেসবক্সে তালি হয় বা সবাই দাঁড়িয়ে যায় তাহলে সেটা বড় নিউজ আইটেম। কারণ ঘটনাটা এতটাই বড় যে, প্রেসবক্সেও তালি বেজেছে, সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। প্রেসবক্স কাজ করার জায়গা। সেখানে আমাদের প্রেসবক্স আর গ্যালারিকে আলাদা করতে পারি না। আসলে এটা খুবই আপত্তিকর জিনিস। আমি তো মনে করি, মিরপুরের প্রেসবক্স হচ্ছে কাজ করার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন জায়গা। এখানে মাথা ব্যথা নিয়ে কাজ করতে হয়।
দেশের ফুটবল শুধুই পেছাচ্ছে। ফুটবলের বর্তমান অবস্থায় আপনি কতটা ব্যথিত? এই অবস্থার কারণ কী বলে মনে করেন?
আমি খুবই ব্যথিত। ফুটবল তো ফুটবলই। গ্লোবাল গেম। এটার কোনো তুলনা চলে না। পৃথিবীতে ক্রিকেট খেলেনি এমন মানুষ প্রচুর পাওয়া যাবে। কিন্তু ফুটবল খেলেনি এমন মানুষ একটিও নেই। দৌড় দেওয়া এবং লাথি মারা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। রাস্তার মধ্যে একটা পাথর দেখলেও আপনি লাথি মারবেন। এটাই মানুষের ন্যাচার। আজ খুবই দুঃখ লাগে। কারণ ঢাকা শহরে দেড় কোটি মানুষ। সেখানে আমাদের ২৩/২৪ হাজার ক্যাপাসিটির ফুটবল স্টেডিয়াম পুরাপুরি খালি পড়ে থাকে। যেটা কি না অসাধারণ স্টেডিয়াম, কি সুন্দর চেয়ার বসানো। একসময় আমরা গাদাগাদি করে বসে খেলা দেখতাম কংক্রিটের বেঞ্চে। কতগুলো কথা বলা হয়, টিভিতে সবাই ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখে বলে বাংলাদেশ ফুটবলের কঠিন সময়। এটা ফালতু কথা। ইন্ডিয়াতে দেখেন, ইস্টবেঙ্গল মোহন বাগান ম্যাচে ৭০-৮০ হাজার দর্শক হচ্ছে। ইন্ডিয়ার ফুটবল কি আমাদের চেয়ে বিরাট কিছু? তারা কি ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখে না? আমাদের ফুটবলের এ রকম হয়ে যাওয়ার কারণ আসলে মাঝখানে ফুটবল অনিয়মিত হয়ে যাওয়া এবং আবাহনী-মোহামেডান ক্রেজ নষ্ট হয়ে যাওয়া। দুই বছর তিন বছর পর একটা লিগ হতো। ফুটবলে ক্লাব হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ ক্লাব এবং নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের টানের কারণে মাঠে যায়। আবাহনী-মোহামেডানের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, উন্মাদনা ছিল সেটা কাজে লাগানো হয়নি, কেউ চেষ্টাও করেনি। এখনো যদি ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় এই দুই দলের বছরে ৪-৫টি ম্যাচ আয়োজন করা হয়, তাহলে কি স্টেডিয়াম ভেঙে পড়বে না? কিন্তু কে কার কথা শুনবে। এগুলো কে ভাবে? আমি আপনি ভাবলে কী হবে?
কাজী সালাউদ্দিনকে ফুটবল প্রশাসক হিসেবে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
তাকে অনেক মার্ক দেব। তাকে নিয়ে অনেক কথা হয়। ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির কাজ খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। তার মূল কাজ হচ্ছে একজন ভালো কোচ ঠিক করা এবং দেশের ফুটবলের সার্বিক একটা কাঠামো ঠিক করা। কিন্তু তার কাছে আমরা সব কিছু আশা করি। তিনি ন্যাশনাল টিম করবেন, জেলা ফুটবল করবেন, উপজেলা ফুটবল করবেন। এটা কোনো দিন সম্ভব নয়। একসময় ২ বছর ৩ বছর এমনকি ৪ বছর পর লিগ হতো। ফুটবলের আসল ক্ষতিটা হয়ে গেছে তখন। এখন ফুটবলের জন্য আন্দোলন করতে হয় না। আমাদের জাতীয় ফুটবল নিয়মিত দেশের বাইরে খেলছে, যেটা এক সময় অকল্পনীয় ছিল। সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা আছে, আলোচনা আছে। কিন্তু আমি তার আগের দুই-তিনটা আমল তো দেখেছি। আমি যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, ফুটবলে তখনও স্বর্ণযুগ। ’৯১, ’৯২ থেকে ’৯৫ বা ’৯৬ সাল পর্যন্ত তো আমার পত্রিকার পুরো পৃষ্ঠায় আবাহনী-মোহামেডানের নিউজ থাকত। ২০০০ সালের পর থেকে ফুটবলের পতন শুরু। অনেক বড় বড় সংগঠন দেখেছি। তাদের সময়েই ফুটবলের পতন দেখেছি। সালাউদ্দিনের জন্য কাজটা কঠিন হয়ে গেছে। মাঝখানে এত কিছু হয়ে গেয়ে যে, আগানো কঠিন। ওনার শেষ টার্ম। আর মনে হয় তিনি ফুটবলে আসবেন না। যাওয়ার আগে যদি ভালো কিছু হয় তাহলে তো ভালোই। কিন্তু আমি সন্দিহান।