একসময়ের ফুটবল আইকন এখন বিজনেস আইকন। দেশের ফুটবল আর রপ্তানিখাত এগিয়ে নিতে এখনো অবদান রেখে চলেছেন। যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। সফল মানুষ আবদুস সালাম মুর্শেদী- তার জীবন, দর্শন, ফুটবল, ব্যবসা, দেশ সবকিছু নিয়ে বিশদ বলেছেন ঢাকাটাইমসকে। আজ দীর্ঘ আলাপচারিতার তৃতীয় ও শেষ পর্ব ছাপা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন।
অন্য প্রসঙ্গ। জীবনকে আপনি কিভাবে দেখেন?
আমার পরিবার বলে আমি নাকি একটা মেশিন। আমার মেয়ে ইয়াংগেস্ট ব্যারিস্টার। পরিবারে আমি যতটুকু সময় থাকি ততটুকু সময় সবার সঙ্গে এনজয় করি। কিন্তু আবার মনে হয় দিনের যেন কোন কাজ বাকি রয়ে গেছে। কাজই আমার কাছে জীবন, কাজটাই বড় ধর্ম।
আপনার জীবনে ধর্মের প্রভাব কী?
একটা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিকভাবে সবকিছু মিলিয়ে আপনাকে কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। ধর্ম কিন্তু আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে না। যেমন আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। ধর্মকে জীবনে রুটিন হিসেবে নিতে হবে। ব্যক্তিগত, সাংসারিক জীবনও কিন্তু ধর্মের একটি অংশ। মানুষকে সাহায্য করাও কিন্তু ধর্মের অংশ। যে যে ধর্মেরই হোক না কেন, সে যদি পালন করে তাহলে তার কোনো কিছুতে ভুল করার কথা নয়।
ধর্ম নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি?
আমি কিন্তু খুবই ধার্মিক মানুষ। আমার পরিবারের সবাই নামাজ পড়েন। একটা সর্বজনীন সত্য যে, আপনি যখন জন্মগ্রহণ করেছেন তখন আপনাকে চলে যেতে হবে। পৃথিবীতে ছোট্ট সময় আপনি যদি ভালো কিছু করে যেতে পারেন সেটিই হবে আপনার জন্য, আপনার পরিবারের জন্য, দেশের জন্য বড় কিছু।
মানুষকে যদি বড় হতে হয় তাহলে যেকোনো একটি জিনিসকে টার্গেট করতে হয়। সেই টার্গেটটাই ছিল আমার রিলিজিয়ন। ধর্মকেই আমি চাবিকাঠি মনে করি। সেজন্যই হয়ত আল্লাহ আমাকে সফলতা দিয়েছেন। প্রতিদিনই সুসংবাদ আসে। তবে, পাঁচটা সুসংবাদ এলে একটা দুঃসংবাদ তো আসবেই।
মৃত্যু নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
আমি মৃত্যুকে কখনোই ভয় পাই না। আমি যখন কারও জানাজায় যাই তখন আমি মনে করি একদিন কেউ হয়ত আমার জানাজা এভাবে পড়তে আসবে। এবার আমার শাশুড়ি হজ করতে যাচ্ছেন। আমার স্ত্রী মাহরাম হিসেবে যাচ্ছেন।
অনেক অর্জন। অনেক প্রাপ্তি। সবকিছু মিলিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট, তৃপ্ত?
আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা যদি কেউ পড়ে তাহলে অনেকেই ঈর্ষা করবে যে, একজন খেলোয়াড় থেকে এত বড় একজন ব্যবসায়ী হয়েছেন। আমি মনে করি, আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন। কারণ, আমার চেয়ে অনেক বড় ডিগ্রিধারী লোক এমন পর্যায়ে আসতে পারেনি।
প্রেমকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ভালোবাসাটা আপনার সবক্ষেত্রেই থাকতে হবে। ভালোবাসাটা যে শুধু পরিবারভিত্তিক তা নয়। আপনাকে ভালোবাসতে হবে মানুষকে, ভালোবাসতে হবে দেশকে। এটিই ধর্ম।
খেলোয়াড় হিসেবে বড় সেলিব্রিটি ছিলেন। দেখতেও সুদর্শন। প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছেন নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ, প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু গ্রহণ করিনি। অনেক চিন্তা ভাবনা করে সেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছি। প্রেমে জড়িয়ে গেলে আমি আজকের জায়গায় হয়ত আসতে পারতাম না। আমার প্রেম শুরু হয়েছে বিয়ের পর। আমি মনে করেছি যে, আমার এমন একজনকে ঘরে আনা উচিত, যে সম্মান দিবে আমাকে, আমার পরিবারকে। আর সর্বদা সেক্রিফাইস করতে প্রস্তুত থাকবে। আমি সেটি পেয়েছি। আমি এনগেইজমেন্টের পরের দিন থেকেই আমার স্ত্রীকে ‘বুড়ি’ বলে ডাকি।
দাম্পত্য জীবন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
আসলে আমি মনে করি, দাম্পত্য জীবনটা হচ্ছে পরীক্ষা। কারণ দুটি ভিন্ন দিকের মানুষকে এক জায়গায় এসে ঘর করতে হয়। আমার বিয়ে হয়েছে ২৬ বছর। আমি মনে করি, দাম্পত্য জীবন, ব্যবসায়িক জীবন সবকিছুই হচ্ছে সেক্রিফাইস।
আপনি মানুষ হিসেবে ইমোশনাল না বাস্তববাদী?
যারা সিনসিয়ার হয় তারা কিন্তু ইমোশনাল হয়। তবে, আমি এই জিনিস কাউকে বুঝতে দেই না। নিজেই হজম করে নেই।
এমন কোনো ব্যাপার আছে, যা আপনাকে আনন্দ দেয়?
আসলে একটা মানুষ একা সবকিছু করতে পারে না। আমি যখন সবাইকে নিয়ে কাজ করি, অন্যরা যখন আমাকে তাদের কাজ সম্পর্কে জানায়, তখন আমার ভালো লাগে। আমি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের লোকদের যখন দায়িত্ব দেই এবং তারা যখন সেটি করে, আপডেট দেয় তখন আমার খুব ভালো লাগে।
আপনি তৃপ্ত হন কখন?
দুটি ব্যাপার বেশ ভালো লাগে। একটা হলো, সন্তানরা যখন ভালো করে তখন আমার খুব ভালো লাগে। যেমন আমার বড় মেয়ে পড়াশোনায় খুবই ভালো। ব্যারিস্টারি শেষ করেছে। ও এখন হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে, আমার অফিসে এসেও বসে। আমাদের পড়াশোনা করানোর জন্য হয়ত আমার বাবার সেরকম সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েরা চেষ্টা করছে। আমার মেয়ে সর্বকনিষ্ঠ ব্যারিস্টার। ভাবতেই মন জুড়িয়ে যায়।
এখনকার তরুণ প্রজন্ম ফেসবুক বা অনলাইনে বেশি সময় দিচ্ছে। তাদের সম্পর্কে কী বলবেন?
আসলে সুস্থ জাতি গঠনে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রত্যেক এলাকায় মাঠ করে দিবেন। আমি তাঁকে সাধুবাদ জানাই। মাঠে তো সবধরনের খেলাই হবে। বর্তমান এই ডিজিটালাইজেশনের যুগে শিশু থেকে শুরু করে সবাই অনলাইনেই সময় বেশি কাটাচ্ছে। হয়ত তারা এখান থেকে জ্ঞানার্জন করছে। কিন্তু প্রতিভা বিকাশের জন্য শারীরিক সুস্থতা প্রয়োজন। আর তার জন্য প্রয়োজন খেলাধুলা। আমার অনুরোধ থাকবে, আমরা যারা সন্তানদের বাবা-মা আছি তারা যেন সন্তানদের শারীরিক কসরতের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় রাখি।
বাংলাদেশ নিয়ে কতটা আশাবাদী আপনি? কতটা সম্ভাবনা দেখেন?
দেখেন, আমার বাবা বা দাদার কোনো ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ছিল না। আমরাই প্রথম দেখছি। বাংলাদেশের মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সবাই খুব সৃজনশীল। আমরা কোনো কিছু দেখলেই কিন্তু করতে পারি। এখন আমাদের দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব মানুষ বিদেশে থাকেন তারা কিন্তু বিনিয়োগ করতে পারেন। আর আমরা যারা সৃজনশীল মানুষ, তারা যদি কাজে লাগাতে পারি তাহলে বাংলাদেশ পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে প্রতিযোগী দেশের মধ্যে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে চলে যাবে।
ভবিষ্যতে কখনো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে কোন বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিবেন?
আমি পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি। সব দেখে আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশে অবকাঠামো প্রয়োজন। আমাদের দেশে যে জনসংখ্যা আছে আমরা যদি তা বোঝা হিসেবে না ভেবে সম্পদ হিসেবে ভাবি এবং তাদের যথাযথ শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে পারি তাহলে তারা অনেক কিছু করতে পারবে।
সর্বশেষ আপনার স্বপ্নের কথা জানতে চাই?
একটাই স্বপ্ন, বাংলাদেশকে আরও অনেক উঁচু অবস্থানে দেখতে চাই। এজন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু সরকার একা কাজ করলে হবে না। সরকারকেও সাহায্য করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে অন্যতম উদীয়মান দেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশনে আমরা মনে করি, নতুন প্রজন্ম আরও অনুপ্রাণিত হবে। সারা বিশ্বে তাঁর নেওয়া নানা পদক্ষেপ প্রশংসিত হচ্ছে। আমাদের সবার উচিত তাঁর পাশে থাকা।