ইলিয়াস কাঞ্চন চিত্রনায়ক হিসেবে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুতে সড়ক নিরাপদ করার সামাজিক আন্দোলনে একপর্যায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বেদের মেয়ে জোছনাখ্যাত বড়পর্দা কাঁপানো এই তারকা। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হিসেবে এখন দারুণ সক্রিয়। পর্দার নায়ক শুধু নয়, সড়কের নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনেরও চিন্তাভাবনা উঠে এসেছে ঢাকাটাইমসের আলাপে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে এর তৃতীয় ও শেষ পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ ঋয়াদ ও শেখ সাইফ
আপনাদের সময়ে সমান্তরালভাবে অনেক নায়ক জনপ্রিয় ছিলেন, কোনো একজনের উপর বাজারটা নির্ভর করতো না। কিন্তু এখন অনেকটা এক নায়ককেন্দ্রিক একটা ব্যাপার চলে আসছে, সেটাকে কিভাবে দেখেন?
আমাদের সময় বহুমাত্রিক সিনেমা নির্মাণ হতো। গ্রামকেন্দ্রিক সিনেমাও হতো, হতো শহুরে গল্পের সিনেমা। ফোক, রোমান্টিক, সামাজিক সিনেমা, অ্যাকশনধর্মী, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিকসহ আরও অনেক ধরণের সিনেমা হতো। যেমন ফারুক ভাই গ্রামের সিনেমা করতেন ‘মিয়া ভাই’ নামে। তার যতগুলো ছবি সবই কিন্তু গ্রামীণ জীবননির্ভর গল্প অবলম্বনে তৈরি। যার জন্য অন্য নায়কদের সাথে তার ক্ল্যাশ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। যদি ওয়াসিম সাহেবের কথা বলি উনি ছিলেন রাজপুত্র, তিনি অভিনয় করতেন রাজা বাদশার। তারপর বুলবুল সাহেব করতেন শহরের গোবেচারা টাইপ চরিত্রগুলো। আর যদি জাফর ইকবালের কথা বলি, একবারে আল্ট্রা মডার্ন ড্যাসিং রোমান্টিক হিরোর চরিত্রগুলোতে অভিনয় করতেন তিনি। রাজ্জাক সাহেবই একমাত্র নায়ক যিনি বহুমাত্রিক চরিত্র করতেন। এই যে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য এগুলোই প্যারালালি জনপ্রিয়তার কারণ। কিন্তু আপনি এখন একজন অভিনেতা থেকে অন্যজনকে আলাদা করতে পারবেন না। শাকিব খান যা করছে ইমন বা নীরবও তাই করছে, ফলে শাকিব খানই জনপ্রিয় থেকে যাচ্ছে। কারণ শাকিব খান সবদিক থেকেই বেটার। ফলে চরিত্রের বহুমাত্রিক বিকাশ ঘটছে না। যদি শাকিব খান সবদিক থেকে বেটার হয়, তাহলে আপনি অন্যদেরকে কেন নিবেন?
তখন অনেক জনপ্রিয় নায়ক, আপনি কিভাবে জায়গা করে নিলেন?
আমি এসে কিভাবে জায়গা করে নিয়েছি- এটি ভালো প্রশ্ন। আমি অবজারভেশন করলাম কিসের অভাব আছে, আমাকে কি করতে হবে? আমি আসলাম ‘বসুন্ধরা’ সাহিত্যনির্ভর একটি ছবি নিয়ে। সাহিত্যনির্ভর ছবির একটা আলাদা ব্যাপার আছে। বসুন্ধরার পর আরেকটি সাহিত্যনির্ভর ছবিতে অভিনয় করি। তারপর অভিনয় করার সুযোগ পাই লাঠিয়ালের চরিত্রে। ডিরেক্টর কনফিউসড হলেন শেষের অ্যাকশন দৃশ্যে বীরত্ব আমাকে দিয়ে দেখাবেন, নাকি নায়িকাকে দিয়ে! গল্পের ডিমান্ড ছিল আমাকে দিয়ে করানো, কিন্তু উনি আমার উপর ভরসা করতে পারছিলেন না, উনি করালেন নায়িকাকে দিয়ে। কারণ সেই নায়িকা তখন বিখ্যাত। তিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়া। উনার ছবিও ভাল ব্যবসা করতে পারলো না আমারও ক্ষতি হয়ে গেল। তখন আমার একটা নামও হয়ে গেল ‘বোদাই’। আমি অ্যালিফেন্ট রোড দিয়ে রিকশাতে যাচ্ছি, তখন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র বলছে এই ‘বোদাই’ হিরো যায়।
পরে এই বদনাম ঘুচালেন কিভাবে?
আমি তখন ভাবলাম আমি অ্যাকশন হিরো হবো, আর অ্যাকশন হিরো বললেইতো হওয়া যায় না। আমি তখন কুংফু শিখার জন্য, ফাইট শিখার জন্য শিক্ষক রাখলাম। তারপর বুঝতে পারলাম নায়কদের কিসের ঘাটতি আছে? এই যেমন, তখনকার নায়করা কেউ নাচে না। তারা বেশি হলে নায়িকার নাচার সাথে সাথে হাঁটে, কেউবা গাছের ডাল ভাঙ্গে, অন্যরা বড়জোর ঢাল ভেঙ্গে পাতা চিবোয়। বোম্বেতে তখন মিঠুন, জিতেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন তুমুল জনপ্রিয় এবং তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাচের ঢং আছে। কিন্তু আমাদের এখানে কেউ নাচে না। আমি তখন নাচের শিক্ষক রেখে নাচ শিখতে শুরু করলাম। তারপর সিনেমায় নাচলাম সিনেমা জন্রিপয়তা পেল। তারপর উজ্জল সাহেবের সিনেমা ‘নসীব’-এ আমার এবং রোজিনার নাচ দেখে হলে মানুষ পয়সা ছুড়ে মেরেছে। কিন্তু এখন যারা কাজ করছে তাদেরও দোষ আছে। তারা নিজেদেরকে তৈরি করতে পারছে না। আমাদের সময়ে প্রত্যেকেরই আলাদা স্টাইল ছিল। জসীম সাহেব ফাইট করতে পারতো, তিনিও জনপ্রিয় ছিলেন। নিজের আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়ে জনপ্রিয় ছিলেন আলমগীরও। কিন্তু এখন একজন থেকে অন্যজনকে আলাদা করার মতো বৈশিষ্ট্য নাই। আপনি যখন মাদ্রাজ বা তামিল একটা ছবি নকল করেন, সেই ফাইটতো শাকিব, নীরব বা ইমনরা পারবে না। কারণ তারা মাস্টার রেখে ফাইট শিখে নাই আমি শিখেছি।
আপনি বলতে চাইছেন, না শিখে আসার কারণেই সমস্যা হচ্ছে।
অবশ্যই। অথচ বোম্বেতে একজন নায়িকা আসার আগে সে সব কিছু শিখে আসে। তাকে প্রত্যেকটা জিনিস শিখে আসতে হয়। আমাদের এখানেও আমরা নায়ক হবার আগে অনেক কিছু শিখে এসেছি। আমি ট্রাক চালানো পর্যন্ত শিখে এসেছি। তা না হলে আমাকে ট্রাক ড্রাইভারের রোল করাবে কি করে। আমি আমার তিন নম্বর ছবিতে ট্রাক ড্রাইভারের রোল করেছি। যদি না পারতাম আমাকেতো নিতো না। কিন্তু এখনকার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কিছুই শিখে আসে না। তারা কাজ করতে করতে শিখে। অলরাউন্ডার হওয়ার জন্য আপনাকে প্র্যাকটিসতো করতে হবে।
যে নায়কটা সবকিছু করতেছে তার মধ্যে কিছু দোষ থাকবে, আপনারও যদি সেই দোষ থাকে তাহলে আপনাকে কেন নেবে? ঐ নায়ক যদি ১২টায় আসে আমিও ১২টায় যাই তাহলে আমাকে কেন নেবে? আমাকে যেতে হবে ৯টার সময়। ডিরেক্টর দেখে বলবে, ছেলেটা সিনসিয়ার আছে।
আপনার অভিজ্ঞতাও কী এমন?
আমাকে একটি ছবিতে নেওয়া হয়েছে, আমি থার্ড নায়ক, আর ওয়াসিম ভাই ফার্স্ট নায়ক। ছবি রিলিজ হওয়ার পর দেখা গেল আমি ফার্স্ট হিরো। কাজের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছি, তাই পরিচালক আমাকে ফার্স্ট নায়ক হিসেবে দেখিয়েছেন।
অনেকের সঙ্গে কাজ করেছেন, স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছেন কার সঙ্গে কাজ করে?
সবার সঙ্গেই কাজ করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। তখনকার প্রত্যেকেই একেকজন লিজেন্ড। তখন আনোয়ার সাহেব, রোজী সামাদ যে পয়সা নিতেন নায়ককেও এতো পয়সা দেওয়া হতো না। তাদেরকে সম্মানও করা হতো।
বড়পর্দায় আপনাকে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে না কেন?
আমাকে নিলে কি সেই সম্মান করবে? করবে না। বরং আমি যে বাজেট চাইবো এটা শুনে সে একটা জুনিয়র আর্টিস্ট নিয়ে নিবে। তাহলে কি আমার ঠেকা পড়েছে আমি যাবো সেটা করতে। আমাদের সময় কিন্তু আনোয়ার সাহেবদের মতো সিনিয়রদের সেভাবে সম্মানটা করা হতো।
অনেক জনপ্রিয়তা, প্রচুর ভক্ত আছে এখনও, চলচ্চিত্রে নিয়মিত হবেন কি না?
এখন ফিরবো কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ আগে হল ছিল প্রায় ১৩০০ থেকে ১৩৫০টি, এখন হল আছে মাত্র ৩০০টি। সিনেমা মুক্তি দেওয়া বা প্রদর্শনের সংকটের মধ্যে সিনেমা করাটা কঠিন ব্যাপার। ইচ্ছেতো হয় আবারো ফিল্ম করি। কিন্তু অনিশ্চয়তার মধ্যে ফিল্ম করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। আমার ছেলেমেয়েরা আমাকে বলে তোমারতো সামর্থ্য আছে, তুমি বছরে একটি ফিল্মতো করতে পারো, সেই সামর্থ্য আমার আছে কিন্তু জেনেশুনে কে লস করতে চায় বলুন। এছাড়া টাকা খরচ করলেই দর্শকরা ছবিটা দেখতে পাবে এমনটাও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।