প্রকাশ : ১৪ আগস্ট, ২০১৬ ০৮:২৩:০৮আপডেট : ১৪ আগস্ট, ২০১৬ ১৬:৩৮:১৭
বঙ্গবন্ধু বললেন, ফরিদ ঘুমাচ্ছে ওকে ডাকিস না
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন
মুন্সিগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। পাকিস্তান পর্বের শেষ তিন বছর আওয়ামী লীগের হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, পরে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার সরকারি দায়িত্ব পান। প্রায় সাত বছর বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। সেই সময়ের অনেক কথা তিনি ১০ আগস্ট ঢাকাটাইমসকে অকপটে বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নতুন কিছু দিক উন্মোচন করেছেন। আজ সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় কিস্তি ছাপা হলো। মুন্সিগঞ্জ গিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তায়েবমিল্লাতহোসেন।
মুক্তিযুদ্ধেঅংশনিলেনকিভাবে?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আমি আগরতলা চলে যাই। সেখানে গ্লাস ফ্যাক্টরিতে ট্রানজিট ক্যাম্প ছিল। একপর্যায়ে এখানে মুজিব বাহিনী (বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট-বিএলএফ) গঠিত হয়। সেখান থেকে দেরাদুনে চাকরাতা ক্যান্টনমেন্টে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আমাদের। মুজিব বাহিনীকে চার সেক্টরে ভাগ করা হয়। চার সেক্টরে প্রধান হিসেবে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। আর্মি ট্রেনিং সেন্টারে তাদের সঙ্গেই আমি ট্রেনিং নেই। তিন মাস ট্রেনিং নিয়ে বৃহত্তর ঢাকা জেলার বিএলএফ প্রধানের দায়িত্ব পাই। আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। প্রথমে পদ্মা পারের ফরিদপুরের চরহাট্টা গ্রামে অবস্থান নেই। পরে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, আড়াইহাজারসহ বিভিন্ন মহকুমায় অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেই।
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন, তখন আমি প্রধানমন্ত্রীর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাই। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার নিলে আমি রাষ্ট্রপতির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে যোগ দেই।
বাংলাদেশেবঙ্গবন্ধুরকর্মময়জীবনকেমনদেখেছেন?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : বঙ্গবন্ধু সকাল নয়টার মধ্যেই বাসা থেকে বের হতেন। আমাকে তাই সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরি থাকতে হতো। ঢাকায় থাকলে প্রায় সময়ই দুপুরের খাবারের জন্য বাসায় আসতেন বঙ্গবন্ধু। ছেলে রাসেল ও নাতি জয়কে নিয়ে সবসময় শিশুসুলভ খেলা করতেন, ওদের আনন্দ দিতেন। দেশের প্রধান হয়েও বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষ থেকে দূরে সরে যাননি। একটা ছোট ঘটনা থেকে তা বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই অফিস শেষে করে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ-ই যেন তাঁর মনে হলো- ‘চল মিরপুরের বস্তির মানুষের অবস্থা কেমন আছে দেখে আসি।’ আবার কখনো কখনো চকবাজারে গিয়ে বাজারের অবস্থা দেখে আসতেন। একদিনের ঘটনা, আমি তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে গাড়িতে বসা। তিনি গাড়ি থামাতে বললেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পাহারায় থাকা পাইলট গাড়ির নিরাপত্তারক্ষীরা তা বুঝতে পারেনি। সেই গাড়ি চলতেই থাকলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে পাইলট গাড়িটিকে নির্দেশ দেই বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছেমতো গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্য।
একদিন কাজের সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্য আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম,‘স্যার আমাকে দুইটি ওয়াকিটকি কিনে দিলে কাজের জন্য খুব সুবিধা হতো।’ বঙ্গবন্ধু আমার কথায় গুরুত্ব দিলেন না। পরে ই. এ. চৌধুরী (সাবেক এসপি) সাহেবকে বিষয়টি আমি জানাই। ই. এ চৌধুরী একদিন বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘স্যার মহিউদ্দিনকে দুইটা ওয়াকিটকি কিনে দিলে নিরাপত্তার কাজ করতে ওর সুবিধা হয়।’
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ঠিক আছে দুইটা ওয়াকিটকির দাম কত?’ তখন তিনি জানালেন, ৩০-৪০ হাজার টাকা হবে। বঙ্গবন্ধু ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমার দেশের মানুষ ঠিকমতো দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পায় না, আর আমি ওকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ওয়াকিটকি কিনে দেব? এমন নিরাপত্তা আমার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশাল নিরাপত্তার থাকার পরেও কত নেতাকেইতো মেরে ফেলেছে। মৃত্যু আসবে মরব।’
আরো একটি ঘটনার কথা বলি। একদিন দুপুরবেলা, আমার বাসায় যাওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে যাওয়ার আগে তার ব্যক্তিগত সেবক ফরিদকে বলে গেলাম, ‘তুই স্যারের পায়ের কাছে বসে পা টিপতে থাক, আমি কাজ শেষ করে ফিরছি।’ ফিরে এসে দেখি, ফরিদ বঙ্গবন্ধুর পায়ের উপর ঘুমাচ্ছে। ওর মুখের লালা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পা ভরে গেছে, দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এক কাত হয়ে শুয়ে আছেন, একটুও নড়াচড়া করছেন না। আমি যেই ফরিদকে ওঠাতে গেলাম, বঙ্গবন্ধু হাত দিয়ে ইশারা করে ওকে ডাকতে মানা করছেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ফরিদ ঘুমাচ্ছে ওকে ডাকিস না।’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। লালা বেয়ে পড়া অস্বস্তিকর বিষয়। অথচ বঙ্গবন্ধুর কাছে কিছুই মনে হলো না। ফরিদের ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, এই জন্য একটুও নড়াচড়া করছেন না। বঙ্গবন্ধু মহামানব না হলে আর কী হতে পারেন!
বঙ্গবন্ধুর কোন বিষয়গুলো অন্যদের চেয়ে তাকে আলাদা করে তুলেছিল?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন মহান নেতা। কারও প্রতি তার আদর-স্নেহের কমতি ছিল না। সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন তার সঙ্গী-সাথীদের প্রতি। বঙ্গবন্ধু সবার খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে পর্যন্ত নজরে রাখতেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধু গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কাছে এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, অনেকে শুধু দেখেই নয়, হাত দিয়ে ধরতে চাইতেন। নিরাপত্তার জন্য আমি বাধা দিলে বঙ্গবন্ধু ধমক দিয়ে বলতেন, ‘মহিউদ্দিন তুই কাকে বাধা দিস, গ্রামের এই দরিদ্র মানুষের মধ্যে থেকেই আমার জন্ম, এই মানুষের ভালোবাসার কারণেই আমি আজ নেতা, এরা গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে আসে আমাকে দেখতে, হৃদয়ের টানে। এই মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আমি আন্দোলন-সংগ্রামে সাহস, শক্তি পাই, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করি। সমাজের এই অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত দরিদ্র মানুষকে সামরিক শাসন ও শোষণের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। আমার প্রতি তাদের বিশ্বাস ও আস্থার প্রতি সম্মান দেখা।’ এরপর থেকে বঙ্গবন্ধুকে কখনো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করিনি।
যেকোনো নেতাকর্মী এমনকি একজন সমর্থকের কথাও বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন এবং সেই বিষয়ে যাচাই-বাছাই করতেন। সকলের মতামত তিনি গভীরভাবে মূল্যায়ন করতেন। যা বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার পক্ষেই সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড়মাপের মহান নেতার সংস্পর্শে যাওয়াটা আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।
বঙ্গবন্ধুরনিরাপত্তাবিষয়কবিশেষকোনোঘটনামনেপড়ে?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : ১৯৭০ সালে একদিকে নির্বাচনি ব্যস্ততা, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধেও আন্দোলন চলছে। এমনি সময়ে এক ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে মারার জন্য বিষ মেশানো ছুরি নিয়ে তার রুমে আসার চেষ্টা করে। আমি লোকটিকে চ্যালেঞ্জ করি। একপর্যায়ে সে আমাকে মারতে উদ্যত হয়। আমি তাকে ধরে ফেলি। তাকে কিছু উত্তম-মধ্যম দেই। বঙ্গবন্ধু এই অবস্থা দেখে উপর থেকে নিচে নেমে আসেন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘ওকে মারছিস কেন? ওর অপরাধ কী?’ বঙ্গবন্ধু জানতে পেরে তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমাকে মেরে তোর লাভ কী?’ পরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। পরের দিন বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা’ হেডলাইন দিয়ে বঙ্গবন্ধু, আমার ও দুষ্কৃতকারীর ছবি প্রকাশ করা হয়।
আপনারসঙ্গেবিশেষকোনোস্মৃতিরকথাজানাবেন?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : একবার ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালে মুন্সিগঞ্জে বন্যা দেখতে গিয়েছিলেন। নৌকা থেকে ইয়াহিয়া খান ঘাটে যে জায়গায় নামবেন, সেখানে সবাই দাঁড়িয়ে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে আমরা স্লোগান দিচ্ছিলাম- ‘ইয়াহিয়া ফিরে যাও’, ‘Go Back Yeahiya’। ইয়াহিয়ার নৌকা কিছুতেই পারে ভিড়াতে পারছিল না। নৌকা থেকে ইয়াহিয়া হাত উঠিয়ে আমাদের থামানোর চেষ্টা করলেন। আমি সবাইকে চুপ করতে বললাম। ইয়াহিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘ What is your demand?’ What is your Demand?
আমি বললাম, ‘We dont want request any relief, we want permanent flood control’। ইয়াহিয়া খান বললেন,‘We dont want request any relief, we want permanent flood control।’
নদী থেকে স্পিডবোটে দাঁড়ানো ইয়াহিয়াকে আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে টেনে তুললাম। তার মতো এত স্বাস্থ্যবান মানুষকে টেনে তুলতে দেখে তিনি বললেন, ‘Very Strong man’। এরপর তাকে রিকশায় উঠানো হলো। তিনি রিকশায় আমাকে পাশে বসতে বললেন। আমি তার পাশে না বসে রিকশার সঙ্গে সঙ্গে দলবল নিয়ে আসলাম। বন্যার পানিতে রাস্তা ডুবে গিয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আহসান সাহেবও ছিলেন। ইয়াহিয়া আহসানকে বললেন, ‘আমার নাম-ঠিকানা দিতে।’
পরে ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ হয়। সেখানে তিনি মুন্সিগঞ্জের ঘটনা তুলে ধরে আমার প্রসঙ্গ তুলেন। ইয়াহিয়া খান বললো, ‘I visit monshigonj. I have seen a boy is very strong, energetic, commanding, powerful like a military. Mr Ahshan what is name of the boy? ’ আহসান চিন্তা করার আগেই বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, ‘I think this name is mohiuddin’।
তখন ইয়াহিয়া খান বললেন, ‘Oh yes yes how you have come to know his name?’
বঙ্গবন্ধু বললেন,‘He is my boy’। ইয়াহিয়া খান বললেন,‘I like to take him make army’। বঙ্গবন্ধু বললেন,‘No no I have a military in my organization. I need him। ইয়াহিয়া খান চলে যাওয়ার পর সবার সঙ্গে আওয়ামী লীগ অফিসে বসে আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু বললেন,‘I feel proud for mohiuddin’। ঘটনাটি সবার মধ্যে বর্ণনা করলেন। একপর্যায়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহিউদ্দিন কী হয়েছে? ইয়াহিয়া খান তোর এত প্রশংসা করল, ইয়াহিয়া খান তোকে নিয়ে যেতে চায়।’ আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘আপনার পায়ের নিচে আমার অবস্থান, এত বড় অবস্থান ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাই না।’