‘সেন্সরবোর্ড বলল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করা যাবে না’
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১১:৫০:৪৪আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১১:৫৭:৩৩
‘সেন্সরবোর্ড বলল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করা যাবে না’
ঢাকাটাইমস
মোরশেদুল ইসলাম নির্মাতা জীবনের প্রায় তিন যুগ পার করেছেন। বিকল্পধারার কাজের মধ্য দিয়ে যে কজন নির্মাতা সাফল্য পেয়েছেন তাদের অন্যতম তিনি। আশির দশকের গোড়ায় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পথচলা শুরু। আগামী, চাকা, দীপু নাম্বার টু, দুখাই, আমার বন্ধু রাশেদ, অনিল বাগচীর একদিন-এর মতো প্রশংসিত অনেক চলচ্চিত্র এসেছে তার হাত ধরে। একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও বৈশ্বিক পর্যায় থেকেও নানা সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। তার নির্মাতা হয়ে ওঠার গল্প, চলচ্চিত্র আন্দোলনের নানা দিক অকপটে বলেছেন ঢাকাটাইমসকে। আলাপের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো আজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দঋয়াদ।
সিনেমারবিষয়বস্তুকীছিল?
বিষয়বস্তু ছিল মুক্তিযুদ্ধের ওপর। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছিল, সেই সময়টা তুলে ধরা। তখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলাও এক ধরনের অপরাধ ছিল। সরাসরি বলা যেত না। আমার মনে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুন্ঠিত হতে চলেছে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরও মনে হচ্ছে অসহায়। এই ব্যাপারটি আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এবং তার মধ্যে ছোট্ট ছেলে তার মতো করে প্রতিবাদ করছে। ঢিল ছুড়ে মারছে এবং সেই ছেলেটার জন্ম ১৯৭১ সালের একজন মুক্তিযোদ্ধার ঔরসে। আমার কাছে মনে হয়েছে যে, এরাই হচ্ছে আগামী দিনের যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে নিয়ে আসবে। এ ধরনের একটি বিষয় নিয়ে আমি ছবিটি করেছিলাম।
সিনেমাটিসেন্সরহলোকি?
৮৩ সালে আগামী ছবিটি আমি সেন্সর বোর্ডে জমা দিলাম, তখন সেন্সর বোর্ড ছবিটি আটকে দিল। সেন্সর বোর্ড বলল, সিনেমাতে গ্রামের ছোট বাচ্চারা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে এগিয়ে আসছিল। তো জয় বাংলা স্লোগানটা ব্যবহার করা যাবে না। আর একটা জায়গা কারেকশন করতে বলল। বলল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বলা যাবে না। শুধু হানাদার বাহিনী বলতে হবে। তো আমি এটা মেনে নিতে পারিনি। মেনে নিলাম না। আমি বললাম এটা হতেই পারে না। তখন এটা নিয়ে আন্দোলন করলাম, রাস্তায় মানববন্ধন করলাম। ৫২ জন বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিল আগামী সিনেমাটা মুক্তি দেওয়া হোক। সে সময় প্রতিটি পত্রিকার প্রথম পাতায় হেডলাইন করে ছাপা হয়েছিল। আমরা আবার সরকারের কাছে আপিল করলাম। আপিল বোর্ডে ছবিটা ছেড়ে দিল। আপিল বোর্ডে যখন আপিল করি তখন আমার বয়স ২৪-২৫। আপিল বোর্ডে তখন চেয়ারম্যান ছিলেন আকবর আলি খান (সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব) ।
আমি যখন আপিলের জন্য গেলাম তখন একজন ডেপুটি সেক্রেটারি বললেন কিসের ছবি, কী ছবি, কী ব্যাপার? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ছবি? সে আরও বলল, এই মুক্তিযুদ্ধ দেশটাকে আরও ডুবাইছে। আমার তো মাথায় রক্ত উঠে গেল। ওই ডেপুটি সেক্রেটারির পাশে বসা ছিলেন এ কে এম আব্দুর রউফ। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার কলার চেপে ধরলাম । আমি বললাম, কী বলতে চাস তুই? লোকটা তখন ভয় পেয়ে গেছে। লোকটা কিন্তু এটা আশা করেনি যে, এ রকম প্রতিবাদ আসবে। রউফ ভাই তখন মধ্যস্থতা করলেন। আমি বললাম মাফ না চাওয়া পর্যন্ত ছাড়ব না। তখন সে লোক মাফ চেয়েছে। ওই লোকটার নামটা আমার মনে নেই।
প্রদর্শনেরব্যবস্থাকিভাবেকরলেন?
আমরা ছবিটা মুক্তি দিলাম ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ১৬ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম প্রদর্শিত হলো ব্রিটিশ কাউন্সিলে। প্রচুর দর্শক হলো। আমাদের একটা ভয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের এই ছবি দর্শক দেখতে আসবে কি না। আমরা ৫ টাকা টিকিটের দাম রেখেছিলাম। আমরা ২টা শো অ্যারেঞ্জ করেছিলাম। দুইটা শোতেই উপচেপড়া ভিড়। পরে আরও কিছু শো বাড়িয়েছি তাতেও দর্শকদের জায়গা দিতে পারিনি। দর্শকরা ব্রিটিশ কাউন্সিলের জানালার কাচ-টাচ ভেঙে ফেলেছিল। পরে আমরা পাবলিক লাইব্রেরিতে আবার শো শুরু করলাম। প্রচুর দর্শকের সাড়া পেলাম ছবিটা দেখার জন্য। এভাবেই শুরু হলো আমার চলচ্চিত্রে যাত্রা।
প্রথমছবিরসাড়াকেমনছিল?
অনেক দর্শকের সাড়া পেয়েছি। আমার ছবি৮৪ সালের শুরু দিকে মুক্তি পায়। আর তানভীর মোকাম্মেলের হুলিয়া ছবি মুক্তি পায় ৮৫ সালের শুরুর দিকে। জাস্ট এক বছর পর। প্রথম কয়েক দিন হুলিয়াও চালানো হয়েছিল। প্রচুর লোক এসেছিল। পাবলিক লাইব্রেরিতে আমরা যখন শো করতাম, লাইন একেবারে রাস্তা পর্যন্ত চলে আসত। একটা শো তখন শেখ হাসিনা এসে দেখেছিলেন। উনিও লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। এটা এরশাদের আমলে। পরবর্তীতে আগামী এবং হুলিয়া একসঙ্গে চালাতাম। আগামী’ এবং হুলিয়া তখন বাংলাদেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে দেখানো হয়নি। তখন আমরা ছোট্ট হল ভাড়া করতাম। স্কুলের, কলেজের হলে সবাই টিকিট কেটে দেখত। ৫ টাকা ১০ টাকা করে।
ব্যবসায়িকদিকথেকেকতটাসফলতাছিল?
‘আগামী’ সিনেমায় শুধু খরচই ওঠেনি, লগ্নির কয়েক গুণ টাকা ফেরত এসেছে। তারপর আমরা ওপেন শো করতে শুরু করলাম। গ্রামে গিয়ে আমরা শো করে বলতাম, আপনারা যে যা পারেন দেন। তারপর গামছা পেতে ধরতাম। তার মধ্যে যে যা পারত ১ টাকা, ২ টাকা করে দিত। কেউ হয়ত একমুঠু চাল দিত। আমরা সবই নিতাম। এজন্যই নিতাম যেন তাদেরও অংশগ্রহণটা থাকে।
প্রথমআন্তর্জাতিকচলচ্চিত্রউৎসবেকখনগেলেন?
আমি যখন ছবি শুরু করি তখন আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। মাত্র অনার্সে পড়ি। আমি যখন প্রথম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ইতালিতে যাই, সেটা ১৯৮৫ সালের কথা। তখন আমি মাস্টার্সের ছাত্র। আমি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পাই ১৯৮৫ সালে।
আপনাদেরমধ্যেবিশ্বচলচ্চিত্রেরপ্রভাবকতটুকুছিল?
বিশ্বের চলচ্চিত্রের প্রভাব আমাদের এখানে সে সময় পড়েছে। আমরা বইপত্র পড়তাম। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত তা ভিন্ন ছিল। বাংলাদেশের এই আন্দোলনটা একটু ইউনিক ছিল। আমাদের চলচ্চিত্র নিজস্বতা বা নিজেদের প্রয়োজনে তৈরি হয়েছে । আমাদের চলচ্চিত্রের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের আন্দোলনকে মেলানো যাবে না। একটা ঘটনা বলি, আমরা একবার গেলাম মানিকগঞ্জের বকজুড়ি গ্রামে। যেটা হিরালাল সেনের গ্রাম বলে পরিচিত। হিরালাল সেনের আমাদের চলচ্চিত্রে বিরাট অবদান রয়েছে। আমরা রাতে গেলাম সেখানে। বিদ্যুৎও নেই। জেনারেটর দিয়ে আমরা প্রজেক্টরের মাধ্যমে ছবি শুরু করব। হঠাৎ করে ঝমঝমে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তুমুল বৃষ্টি। আমরা ওখানের ইউপি চেয়ারম্যানের বাসায় আগে থেকেই ওঠার কথা ছিল। সেখানেই উঠলাম। তার বাসায় রাতে খাব। কিন্তু আমরা ফিরতে পারছি না। কারণ তখনও প্রচুর বৃষ্টি। রাত তখন প্রায় একটা বাজে। বৃষ্টি কমল। তখন লোকজন রিকুয়েস্ট করছে যে ছবিটা এখন শুরু করেন। বাড়ির উঠানে তখন কিছু লোক ছিল। যেই জেনারেটরটা স্টার্ট করলাম দেখা গেল জেনারেটরের শব্দে ১০ মিনিটে পুরো উঠান ভরে গেল। তারপর আমরা শুরু করলাম।
আমার কাছে মনে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ আমার দেখা জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। ১৯৭১ সালে আমি ক্লাস এইটে পড়তাম। আমার বয়স তখন তেরো বছর ছিল। আমি মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছি প্রত্যক্ষভাবে। পুরান ঢাকায় আমরা থাকতাম। কিছুটা পরোক্ষভাবে হলেও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সেটা কেমন? সেটা হচ্ছে যে, আমার বড় ভাই (খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম) মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। উনি আমার আট বছরের বড়। একই দিনে আমাদের জন্ম। পয়লা ডিসেম্বর। আর উনি যখন ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এলেন, তখন উনি মাঝে মধ্যে আসতেন, কিন্তু বাসায় থাকতেন না। তিনি এসে আবার চলে যেতেন। যখন আসতেন লুকিয়ে কিছু অস্ত্র নিয়ে আসতেন। মুড়ির টিনে করে। টুকরিতে করে। তার মধ্যে গ্রেনেড থাকত, পিস্তল থাকত। সেগুলো আমরা লুকিয়ে রাখতাম। আমাদের বাসার পাশে একটা গলি ছিল। ওখানে একটা ইটের স্তূপে ইট সরিয়ে মাটির গর্ত খুঁড়ে আমার ২ বড় বোন এ কাজে অংশগ্রহণ করতেন। একবার কারফিউ দিয়ে দিল। তখন বাসায় একটা পিস্তল ছিল। আমরা ছাদের টিনের চালে পিস্তলটি রেখে দিয়েছিলাম। আর্মি আসেনি। তবে আমরা খুব টেনশনে ছিলাম। সেবার এক ঘটনা ঘটল। আমাদের বাসার একটু দূরে জালাল ভাইয়ের বাসা ছিল। জালাল ভাইয়ের বাসায় মিটিং হচ্ছে অপারেশন করার জন্য। তখন আর্মিরা সাদা পোশাকে পুরো বাড়িটা ঘিরে ফেলে। ওরা টের পেয়ে সবাই দেয়াল টপকে পালিয়ে আসে। তখন আমাদের টেবিলের তলায় জুতার বাক্সের ভেতর তিনটা গ্রেনেড রাখা আছে। আর সেগুলো পেয়ে গেলে মুশকিল। তখন আমি যেহেতু ছোট ছিলাম, আমাকে পাঠানো হলো এগুলো নিয়ে আসো। আমি গেলাম। আর্মিরা তো চারদিকে আছে, আমি ঢুকে গেলাম, খালামণি আমাকে জুতার বাক্সটি দিয়ে দিলেন, আমি স্মার্টলি নিয়ে বের হয়ে চলে আসছি । তখন আমার একটা স্কুলের ফ্রেন্ড জিজ্ঞাসা করছে এটার ভেতর কী? আমি বললাম জুতা। সে বলল দেখব দেখব। সে দেখবেই। আমি দেখাতে চাই না। পরে আমি তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে পাশের ড্রেনে ফেলে দিয়ে চলে এসেছি। এ রকম ঘটনা ঘটেছে। আমার মধ্যে ওই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো খুবই জ্বলজ্বলে। এ কারণে আমার ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ বারবার ফিরে আসে। আমি অনেক মুক্তিযুদ্ধের ছবিও করেছি।
আগামীকাল তৃতীয় পর্ব : সেলিম আল দীন বললেন, খুবভালোছবিবানিয়েছিস