লেখালেখি মানুষকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায় : উৎপল শুভ্র
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১০:৩৭:২৯
লেখালেখি মানুষকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায় : উৎপল শুভ্র
ক্রীড়া সাংবাদিকদের মধ্য থেকে একজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে, তিনি কে? উৎপল শুভ্রর জন্ম না হলে এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই ভাবাতো, দু-চারজনের ছোট একটা তালিকা হতে পারত। সাবলীল উপস্থাপনা, জাদুকরী লেখনী, স্বকীয়তা আর নির্ভীক সাংবাদিকতা দিয়ে তিনি নিজেকে অভাবনীয় এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যার ধারেকাছে নেই অন্য কেউ। ক্রীড়া সাংবাদিকতা যদি সাহিত্য হয়, উৎপল শুভ্র তবে হুমায়ূন আহমেদ। আলাপচারিতার প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো আজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন।
সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। একজন প্রকৌশলীর জন্য তো সেটা আরো ঝুঁকির। এতটা সাহস আর আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলেন কোত্থেকে?
আমি যে প্রকৌশলী কথাটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আসলে আমার নিজেরও এটা মনে থাকে না। কথাটা শুনে আমি চমকে গেছি। কারণ অনেক আগের কথা তো। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছি সেই ২৭ বছর আগে। আমি আসলে খুব ভেবেচিন্তে এ পেশায় আসিনি। সত্যি কথা হলো, শুধু এই পেশায় নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই মনে যেটা চেয়েছি সেটাই করেছি। একটা হলো ব্রেইন দিয়ে পরিচালিত হওয়া, অন্যটা হার্ট দিয়ে। আমি সবসময় হার্ট দিয়ে পরিচালিত হয়েছি, ব্রেইন দিয়ে নয়। সবখানেই হার্ট দিয়ে দিয়েছি। আরও অনেক ব্যাপার আছে যেগুলো বলার মতো নয়, যেগুলো হয়ত সমাজ পারমিট করে না এবং সেভাবে প্রচলিত নয়। কিন্তু আমার কাছে যেটা ঠিক মনে হয়েছে, আমি সেটাও করেছি। সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে নেওয়ার লক্ষ্য আমার ছিল না কখনোই। ছাত্রজীবন থেকে আমি খেলাধুলা নিয়ে লেখালেখি করতাম। ঢাকায় বেশির ভাগ পত্রিকা-ম্যাগাজিনে তখন লেখা পাঠাতাম। তারা আমার চেহারা না দেখলেও; লেখা নিয়মিত ছাপা হতো ঢাকার অধিকাংশ পত্রিকায়। তবে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার তেমন কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ঘটনাচক্রে অনেক জিনিস একসঙ্গে মিলে গিয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করলাম, চাকরি করলাম ছয়-সাত মাসের মতো। বাজারে আজকের কাগজ এলো। কিছু ছেলেমেয়ে ওখানে এলো, যাদের সাংবাদিকতার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। তখন মনে হলো সাংবাদিকতা পেশা অন্যভাবে নেওয়া যায়। চাকরি ছেড়ে সেখানে যোগ দিলাম। আজকের কাগজ ছিল নতুন ধারার একটি পত্রিকা। তখনও আমার পরিকল্পনা ছিল যে, কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার। অবশ্য ওখানে কিছুটা ভালোও লেগে গেল। বছরখানেক একটু সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। একটা চাকরির ইন্টারভিউও দিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ ভালো হয়েছিল, চাকরিটা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে জানলাম, অন্য আরেকজন অনেক টাকা-পয়সা দিয়ে চাকরিটা নিয়ে নিয়েছে। এরপর ভোরের কাগজে এলাম। সব মিলিয়ে দৈনিক পত্রিকায় তো ২৫ বছর হয়ে গেল।
কিসের টানে সাংবাদিকতা শেষ পর্যন্ত ছাড়া হলো না?
ভালো লেগে যাওয়ার বিষয়টা তো আছেই। যদিও সাংবাদিকতায় এখন আগের চেয়ে টাকা-পয়সা বেশি। তবে নিরাপত্তাটা যে খুব ভালো, তা বলব না। কারণ দু-চারটা মিডিয়া হাউস বাদ দিলে বাকিগুলো খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। কিন্তু আমরা সে সময়টায় খুব ইনজয় করেছি। আমাদের জীবনে তখন বিকাল ছিল, সন্ধ্যা ছিল। আমরা আড্ডা দিয়ে, শাহবাগ, বইমেলা ঘুরে তারপর অফিসে যেতাম রাতে। এখনকার বিবাহিত জীবন হলে অবশ্য ক্ষতির কারণ হতো। কারণ কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে আজান দিয়ে দিত। একটা ব্যাপার হলো, সাংবাদিকতা আমার কাছে কখনোই কাজ মনে হয়নি। দেখেন, পৃথিবীতে ৯৯ শতাংশ লোক কাজ করেন। কাজ উপভোগ করেন কি না এমন প্রশ্ন করলে তারা হাসবে। বলবে, কাজ আবার উপভোগ করার কী আছে! এই জায়গায় আমরা আসলে ভাগ্যবান। আমরা এমন পেশায় আছি, যেখানে কাজও উপভোগ করা যায়। এখনকার সাংবাদিকতায় অনেক চাপ। জীবন থেকে প্রতিদিন ৭, ৮, ৯ ঘণ্টা দিয়ে দিচ্ছি অফিসের কাজে। কিন্তু বলতে পারি, আমার ক্যারিয়ারের ৯০ শতাংশ সময়ই আমি উপভোগ করেছি। এ পেশায় থাকার ইচ্ছা আমার আদৌ ছিল না। কিন্তু এখানে এসে যা করেছি এবং যা পেয়েছি তা তুলনাহীন। সারা পৃথিবী দেখেছি। আমি তৃপ্ত।
দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতা শুধু নয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের সেরাদের ছোট্ট একটা তালিকা করলে আপনি ওপরের দিকেই থাকবেন। তারপরও কখনো কি মনে হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় থাকলেই বরং ভালো হতো, অন্তত অভিমান করে হলেও?
না, এমন কিছু মনে হয়নি। ২৭ বছর আগে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছি। ইঞ্জিনিয়ারদের সমাজে সম্মানজনক অবস্থান। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই এখন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। সমাজে তারা প্রতিষ্ঠিত। তবে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বলুন বা অন্য দিক দিয়ে বলুন আমিও ভালো আছি। আমার কোনো অনুশোচনা নেই। জীবনে যা পেয়েছি তার তুলনা নেই। এত কিছু পাব ভাবিওনি।
দেশের স্পোর্টস সাংবাদিকতায় নতুন ধারার প্রবর্তক আপনি। আপনার এ ধারা তুমুল জনপ্রিয়তা পেল। আপনি সেলিব্রেটি হলেন। ভালো লাগে নিশ্চয়ই। কিন্তু সব অর্জনের পেছনেই তো অনেক কষ্ট, ত্যাগ, সাধনা থাকে।
এটা তো আসলে খারাপ লাগার কোনো কারণ নেই। সত্যিকার অর্থে যেটা বললাম, এ পেশায় ভেবেচিন্তে আসিনি। আর ওই যে ভিন্ন ধারার কথা বললেন, এটাও যে খুব ভেবেচিন্তে করেছি, তা নয়। আমি প্রচুর সাহিত্য পড়তাম। এখনো পড়ি। ভাষার যে ব্যাপারটা, সেটা আমার মধ্যে অটোমেটিক ছিল। এটা আমাকে খুব সাহায্য করেছে। সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে নেওয়ার ইচ্ছা যেহেতু ছিল না, তাই আমার মধ্যে আলাদা একটা সাহস ছিল। এটা হয় না, ওটা হয় না, এই নিয়ম আমার কাছে পাত্তা পায়নি। শুরুর দিকে আমার মনে আছে, প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। আমি সাংবাদিকতা ধ্বংস করে দিচ্ছি। কিছুই হচ্ছে না। আপনি যেমন বলেছেন আমার প্রচুর ভক্ত আছে, এটা যেমন ঠিক, আবার অনেক সমালোচকও আছে। এখনো অনেকে বলেন, আমি সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। কিন্তু এতে আমি কিছু মনে করি না। আমি জানি, আপনি যখন আলাদা কিছু করতে যাবেন, অনেকের কাছে সেটাই নেগেটিভ। আসলে নতুন কিছু করতে গেলে কারো কাছে ভালো লাগবে, কারো খারাপ লাগবে। আপনি যদি সাধারণ, সাদামাটা জিনিস করেন, যেমন গরু ঘাস ঘায়, তাতে কোনো আলোচনাও হবে না, সমালোচনাও হবে না। কিন্তু যখন আপনি ইম্পপ্রোভাইজ করতে যাবেন তখনই নানা সমস্যা। কিন্তু আমি এগুলো বড় করে দেখিনি। এটাই আমার পেশা, এটাই আমার স্বপ্ন, এটা নিয়েই বড় হতে হবে, এগুলো লম্বা সময় ধরে চিন্তা করিনি। আমি প্রচুর পড়াশোনা করেছি, তাই পাঠক হিসেবে আমার মন যেটা চেয়েছে, সেটাই করেছি। ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে প্রচণ্ড পড়ার নেশা ছিল। শুধু খেলাধুলার লেখাই নয়, হুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে মাসুদ রানা, মোট কথা ছাপা অক্ষর হলেই হলো। আমি জাগ্রত আছি আর লেখা পড়ছি না, এমন ঘটনা বোধকরি নেই।
কিন্তু কী কারণে যে খেলার নেশাটা আমার মাথার মধ্যে ঢুকলো আমার জানা নেই। এটা বিস্ময়কর ঘটনা। আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীতেও খেলাধুলার ইতিহাস নেই। যখন শুরু করেছি, একজন পাঠক হিসেবে যেভাবে পড়তে চেয়েছি সেভাবেই করেছি। যে কারণে আমি করতে পেরেছি। এই ভয়টা ছিল না যে, না পারল যে চাকরি চলে যাবে বা এখানে থাকা যাবে না। কারণ আমি পেশা হিসেবেই তখনও এটাকে নিইনি।