সামনের চার বছর তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এমন কাজ করে যেতে চান যার ওপর ভর করে ফুটবল ভালো মতো দাঁড়িয়ে যায়। ফিরে পায় গৌরব। বাংলাদেশ ফুটবলকে এশিয়া লেভেলে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের কথাই শোনালেন কিংবদন্তি ফুটবলার ও সদ্য নির্বাচিত বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। তার সঙ্গে কথা বলেছেন দেলোয়ার হোসেন ও সদর উদ্দিন লিমন
প্রশ্ন: টানা তৃতীয়বার বাফুফে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন।
কাজী সালাউদ্দিন: আপনাদেরও অভিনন্দন।
প্রশ্ন: অনেক কঠিন সিচুয়েশনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন পার করলেন। গত দুই মাসে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে এখন কোন পর্যায়ে?
কাজী সালাউদ্দিন: আসলে শারীরিক ও মানসিক ধাক্কাটা আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু আবার কাজে ফিরে এসেছি। এটিই আমার কাছে সবসময় অগ্রাধিকার পায়। কাজ আমি পছন্দ করি।
প্রশ্ন: এই নিয়ে তিনটি নির্বাচন করেছেন। এর মধ্যে আপনার কাছে আলাদা মনে হয় কোনটা?
কাজী সালাউদ্দিন: আমার এ ব্যাপারে বলার কিছুই নেই। আপনারাই দেখেছেন, আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। নির্বাচন নিয়ে কত কিছু হয়েছে। যাক ও সব কথা।
প্রশ্ন: নির্বাচনে আপনার কাছে সবচেয়ে কঠিন সিচুয়েশন ছিল কোনটা?
কাজী সালাউদ্দিন: আসলে সব সিচুয়েশনই সমান। আমি আলাদা করে কিছু বলতে চাচ্ছি না। ইলেকশনটা হয়ে গেছে। কেমন হয়েছে, আমার চেয়ে আপনারা ভালো জানেন। আপনারা বাইরে ছিলেন। অনেক কঠিন মুহূর্ত পার করে আসছি। এজন্য আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, ভোটারদের কাছে কৃতজ্ঞ। মিডিয়ার কাছেও কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: নির্বাচনে কঠিন সিচুয়েশনে অনেককেই আপনি পাশে পেয়েছেন। আবার অনেকে আপনার পাশে ছিলেনও না। যারা পাশে ছিলেন এদের মধ্যে যদি বিশেষ একজনকে বেছে নিতে বলি তাহলে আপনি কাকে বেছে নিবেন?
কাজী সালাউদ্দিন: আমি এই কমেন্টটা করব না। কারণ, আমার সঙ্গে যারা ছিল তাদের মধ্যে যদি আমি একজনের নাম বলি তাহলে অন্যদের প্রতি অবিচার করা হবে। আমি ধন্যবাদ জানাই আমার টিমের সবাইকে। আমি নির্দিষ্ট করে কারও নাম বলতে পারব না।
প্রশ্ন: আপনি তো মিডিয়ার প্রচুর সমর্থন পেয়েছেন?
কাজী সালাউদ্দিন: অবশ্যই। এ জন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: নির্বাচনের কোন বিষয়টা আপনাকে সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছে?
কাজী সালাউদ্দিন: আমাকে কষ্ট দেয়, যখন দেখি টেলিভিশনের টক শোতে কেউ মিথ্যা কথা বলছে। আপনি সত্য কথা একশটা বলেন, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার দোষ থাকতেই পারে। আমি তো আর ফেরেশতা নই। মিথ্যা দোষ দেওয়াটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়।
প্রশ্ন: গত দুই মেয়াদ মানে আট বছর সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এবারেরটা নিয়ে টানা ১২ বছর। ফুটবল উন্নয়নের জন্য এটা কী অনেক সময় নয়?
কাজী সালাউদ্দিন: আমি আট বছর কাজ করেছি। ফুটবল উন্নয়ন আসলে এত সহজ ব্যাপার নয়। বিশ্বের ২০৯টি দেশের মধ্যে ২০৪টি দেশ ফুটবল খেলে এবং সেই সঙ্গে উন্নতিরও চেষ্টা করে। আমরাও চেষ্টা করি। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের ফুটবল আরও অনেক দূর যেতে পারবে।
প্রশ্ন: সামনের চার বছরকে আপনি কীভাবে নিচ্ছেন?
কাজী সালাউদ্দিন: অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এখন আট বছরের খাটুনিটা এই চার বছরে চোখে পড়বে। গত আট বছরে অনূর্ধ্ব-১৬ দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। অনূর্ধ্ব-১৪ মহিলা দল চ্যাম্পিয়ন হলো। নিয়মিত লিগ হয়েছে। খেলা কোনো বছর বাদ যায়নি। ৪৭টি জেলায় লিগ হয়।
প্রশ্ন: আপনি কোন বিষয়টি গুরুত্ব দিবেন?
কাজী সালাউদ্দিন: তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিব। প্রথমটি হলো গ্রামগঞ্জ থেকে ফুটবলার তুলে আনা ও নিয়মিত খেলা পরিচালনা করা। দ্বিতীয়টি হলো, একাডেমি ও ক্লাবগুলোকে নিয়ে কাজ করা। তিন, জাতীয় দলের প্রতি বাড়তি নজর রাখা। আমরা ২৫ দফা ইশতেহার দিয়েছিলাম। তবে এর মধ্যে কিছু বিষয় অগ্রাধিকার দিব। জেলা পর্যায়ে ফুটবলের উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ করতে চাই। ক্লাবগুলোকে আনতে চাই আধুনিক ফুটবলের ধারায়। আর আমার আশা যে, জাতীয় ফুটবল দল এবার প্রত্যাশিত সাফল্য নিয়ে আসবে। তবে এর মানে এই নয় যে, একাডেমি, মহিলা ফুটবল আর স্কুল ফুটবল ও অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কাজ হবে না। এগুলো নিয়েও কাজ হবে।
প্রশ্ন: ফুটবল উন্নয়নে বাফুফের দায়িত্ব তো আছেই। অন্য কারোর কী কিছু করার নেই?
কাজী সালাউদ্দিন: ফুটবল উন্নয়নে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো ক্লাবগুলোর। পৃথিবীর কোনো দেশের ফুটবলের উন্নয়ন ডিস্ট্রিক্টও করে না, ফেডারেশনও করে না। করে ক্লাবগুলো। আপনি যদি ডেভিড বেকহ্যামকে দেখেন, তাকে কিন্তু ইংল্যান্ড বানায়নি। তাকে বানিয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। মেসিকে বানিয়েছে বার্সেলোনা। এগুলোই হচ্ছে উদাহরণ। আমাদের এখানে কিছু ঘাটতি আছে।
প্রশ্ন: ক্লাবগুলোতে বয়সভিত্তিক দলে বাধ্যবাধকতা করবেন কি না?
কাজী সালাউদ্দিন: দেখুন, তাদের কিন্তু বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনতে পারবেন না। যদি আনেন, তাদের আপনি শাস্তি দিতে পারবেন না। লিগে যদি কেউ না খেলে তাহলে আপনি তাকে সাসপেন্ড করতে পারেন। কিন্তু বয়সভিত্তিক দলে আপনি সেটি করতে পারেন না। তারা খেলবে কি না খেলবে এটি তাদের ব্যাপার।
প্রশ্ন: বাফুফেতে এমন অনেক সভাপতি এসেছেন। যাদের সময়ে ঠিকমতো লিগই হয়নি। তারা আবার আপনার সমালোচক। টক শোতে গিয়ে নানা কথা বলেন। আপনি ব্যাপারটা কীভাবে নেন?
কাজী সালাউদ্দিন: আপনারা একটু এই বিষয়টিই ভালোভাবে ম্যানশন করবেন। যারা এত বড় বড় কথা বলে তাদের গত ২০ বছরের পারফরম্যান্স কী?
প্রশ্ন: আপনি যেহেতু কাজী সালাউদ্দিন। পেলে, শচীন টেন্ডুলকার ও ব্রায়ান লারাদের কাছে যেমন প্রত্যাশা বেশি থাকে, ঠিক আপনার কাছেও তাই। মাঠে আপনি সবার প্রত্যাশা মিটিয়েছেন। কিন্তু বাফুফেতে নিজের কাজের মূল্যায়ন কীভাবে করেন?
কাজী সালাউদ্দিন: প্রত্যাশা থাকবে না কেন? আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: আপনি কী মনে করেন সামনের বছরগুলোতে সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন?
কাজী সালাউদ্দিন: ফুটবল ২০৯টি দেশ খেলে। আপনি ফিফার কোনো কংগ্রেসে গেলে ২০৯টি দেশের প্রেসিডেন্টকেই উপস্থিত পাবেন। ইউএসএও অনেক চেষ্টা করে ফুটবলে টপে আনতে পারেনি। এটি অনেক কঠিন কাজ। আমরাও চেষ্টা করছি। সরকার, জনগণ, মিডিয়া আপনারা সবাই আমাদের সাপোর্ট করেন। দেখি কোথায় যাওয়া যায়।
প্রশ্ন: ফুটবল উন্নয়নে সরকারেরও তো বড় ভূমিকা থাকা উচিত। সরকার কি পারে না এখানে ১০০ কোটি টাকা বাজেট রাখতে?
কাজী সালাউদ্দিন: হ্যাঁ, এটি একটি দেশের জন্য কোনো টাকাই নয়। আমি চেষ্টা করব যাতে সরকার ফুটবল ফেডারেশনের প্রতি নজর দেয়। গত বাজেটেও আমি চেষ্টা করেছি। এবারও আমি করব। দেখি অল্প কয়েকদিনের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমি তাঁকে রিকোয়েস্ট করব।
প্রশ্ন: ফুটবল অধোগতির দায় যেমন ফেডারেশনের, তেমনি সরকারের তো আছে?
কাজী সালাউদ্দিন: আমি কাউকেই দোষারোপ করছি না। আমার কথা হচ্ছে, আপনারা সবাই আসেন দেখা যাক কী হয়। আমার মনে হয় ফুটবলে টপে যাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। সেটি আপনারা মানেন আর নাই মানেন। এটি ইউএসও পারেনি, চীনও পারেনি, রাশিয়াও পারছে না। সুতরাং ফুটবলে উন্নতি করতে হলে শুধু সরকার এগিয়ে আসলে হবে না। এখানে সরকার, জনগণ, মিডিয়া সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।
প্রশ্ন: অনেকেই বলে থাকেন শুধু বিশেষ নামের ক্লাব দিয়ে ফুটবল জাগরণ সম্ভব নয়। দরকার জেলাভিত্তিক ক্লাব। ম্যাচ হবে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে। তাহলে ভালো কিছু সম্ভব। কারণ ঢাকার বাইরে অনেক দর্শক হয়। আপনাদের এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
কাজী সালাউদ্দিন: অবশ্যই আছে। আমরা এটি করতে পারেনি। এ বছরই আমি চেষ্টা করব এটি করতে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ সুপার লিগ (বিএসএল) নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আপনি এটি নিয়ে আলাদা কোনো স্বপ্ন দেখেন কি না?
কাজী সালাউদ্দিন: বিএসএল হবে কি না আমি জানি না। তবে, হলে আশা করি ভালো হবে। অনেক সাপোর্ট পাব। কিন্তু আমার মূল লক্ষ্য হলো প্রফেশনাল লিগকে টপে রাখা।
প্রশ্ন: গত কয়েক বছরে অনেক বিদেশি কোচ যাওয়া-আসা করেছেন। দেশি কোচের অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। কোচ নিয়ে আপনার বিশেষ কোনো পরিকল্পনা?
কাজী সালাউদ্দিন: বিদেশি কোচ নিয়ে এখনো চিন্তাভাবনা শুরু করতে পারিনি। আসলে আবার সভাপতি হব কি না তার তো কোনো নিশ্চয়তাও ছিল না। আমার তো ইচ্ছা নতুন করে ঢেলে সাজাব জাতীয় দলের সবকিছু। নতুন কিছু পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে চাই।
প্রশ্ন: নেতৃত্ব দিতে গেলে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। আপনিও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন এবং সফল হয়েছেন। আপনি কী এই চ্যালেঞ্জগুলো প্রেসার হিসেবে নেন, না এনজয় করেন?
কাজী সালাউদ্দিন: দুটোই। অনেক সময় প্রেসার হিসেবে নিই। আবার অনেক সময় এনজয় করি। এটিই হলো সত্যি উত্তর।
প্রশ্ন: ফুটবল নিয়ে আপনার বিশেষ কোন বক্তব্য...
কাজী সালাউদ্দিন: আমাদের জন্য সামনের চারটি বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এমন একটা ভিত্তি রেখে যেতে চাই যেটি আগামীতে যারা ফুটবলের দায়িত্ব নেবে তাদের কাজ অনেক সহজ করে দেয়। এবার আমি নিয়মশৃঙ্খলার ব্যাপারে অনেক কঠোর থাকব। দিন শেষে যেহেতু সব দায়-দায়িত্ব নিতে হয় আমাকেই, তাই প্রতিটি কমিটিতে যোগ্য লোক আছে কি না তা যাচাই-বাছাই করব।