ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ৫৪ ধারা ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) ১৬৭ ধারা সংশোধন মামলায় হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। ২৪ মে রায় ঘোষণার আগে এই মামলার শুনানিতে চলে গেছে ১৮ বছর। রিট আবেদন (ড্রাফট) লেখা থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় আদালতে উপস্থিত থেকে এর কার্যক্রমে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান। যুগান্তকারী এই রিট ও রায়ের বিস্তারিত নিয়ে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার মোসাদ্দেক বশির।
ঢাকাটাইমস: ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনে হাইকোর্টের রায় বহাল আছে আপিল বিভাগে। এ রায়কে কীভাবে দেখছেন?
ইদ্রিসুর রহমান: এটি একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়। মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি ছিলাম। রিট হওয়ার পর দীর্ঘ ১৮ বছর পর এ মামলার রায় এসেছে। হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনা আপিল বিভাগের রায়ে বহাল রয়েছে। এতে আমরা অত্যন্ত খুশি। এত দিনের ধৈর্য্য সফল হয়েছে।
ঢাকাটাইমস: রায় ঘোষণার দিন আদালত কী বলেছিলেন?
ইদ্রিসুর রহমান: আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে দিয়ে বলেছিলেন, এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করে দেবেন আদালত। অতীতের একটি মামলা উদাহরণ দিয়ে আদালত বলেন, ‘নির্দেশনা দিলে সেটি মানা হয় না। তাই আমরা নির্দেশনা না দিয়ে সেগুলো গাইডলাইন আকারে দিয়ে দেব।
ঢাকাটাইমস: ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক.......
ইদ্রিসুর রহমান: ভারত উপমহাদেশের প্রতিটি দেশেই এই আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে ১৫-২০ বছর আগে। আমাদের দেশেও আইনটি যুগোপযোগী করা সময়ের দাবি। আদালতের এ ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে এ সংশোধনের সূচনা হবে আশা করি। এতে আইনের শাসন কায়েম হবে। বিনা বিচারের মানুষকে হয়রানি বন্ধ হবে।
ঢাকাটাইমস: এই মামলার ইতিহাসটা শুনতে চাই।
ইদ্রিসুর রহমান: ১৯৯৮ সালের কথা। ইনডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেলকে ডিবি পুলিশ রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে। এরপর অমানুষিক নির্যাতনের কারণে ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়। আওয়ামী লীগের সরকারের সময় ঘটা এ ঘটনায় সারা দেশে তুমুল হইচই হয়। ওই ঘটনায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন এবং কয়েকজন ব্যক্তি মিলে হাইকোর্টে রিটটি দায়ের করেন।
ইদ্রিসুর রহমান: সন্দেহবশত বিনা পরোয়ানায় ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার এবং অধিকতর তদন্তের নামে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় এমনকি নির্যাতনের ফলে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুও ঘটে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয় রিটে। এ ছাড়া গ্রেপ্তার ও তদন্তসংক্রান্ত প্রচলিত আইন ও সাংবিধানিক বিধিবিধান (অনুচ্ছেদ ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৫) যথাযথভাবে পালন এবং গ্রেপ্তারের পরপরই আসামিকে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগদানের জন্য রিট পিটিশনে উল্লেখ করা হয়। আর ওই ঘটনায় (রুবেল হত্যা) সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধান দলের রিপোর্টে পেশকৃত ১১টি সুপারিশের বিষয়ে আদালতের কাছে ‘দিকনির্দেশনা’ চাওয়া হয়েছিল।
ঢাকাটাইমস: এর পরের ঘটনা......
ইদ্রিসুর রহমান: ১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর মাননীয় হাইকোর্ট সন্দেহবশত কাউকে গ্রেপ্তার এবং তদন্তের নামে রিমান্ডে নিয়ে আসামিকে শারীরিক নির্যাতন করা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, সে ব্যাপারে সরকারের ওপর রুল জারি করেন।
ঢাকাটাইমস: বিবাদী করা ছিল?
ইদ্রিসুর রহমান: পাঁচজনকে বিবাদী করা হয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের মহাপরিদর্শক, উপ-মহাপরিদর্শক এবং সহকারি পুলিশ সুপার।
ঢাকাটাইমস: এরপর দীর্ঘ সময় চলে যায় শুনানিতে...
ইদ্রিসুর রহমান: হ্যাঁ। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনে যুগান্তকারী রায় দেন। রায়ে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলিত বিধান পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে সংশোধন করার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়। পাশাপাশি এই ধারাগুলো সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত রায় ঘোষণার পর থেকেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্তৃপক্ষকে ১৫ দফা নির্দেশনা মেনে চলতে নির্দেশনা ছিল। ধারা দুটি সংশোধনে সাতটি সুপারিশ করা হয় রায়ে।
ঢাকাটাইমস: মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে এত সময় লাগার কারণ কী?
ইদ্রিসুর রহমান: সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ শুনানিতে সময় নিয়েছে।
ঢাকাটাইমস: হাইকোর্টের রায়ের পর সরকার কোন যুক্তিতে আপিল করল?
ইদ্রিসুর রহমান: সরকার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। তবে তাদের আপিল শুধু হাইকোর্টের দেয়া সুপারিশমালার বিষয়টুকু গ্রহণ করা হয়েছিল। যখন আপিল করা হয় তখন বিএনপি ক্ষমতায়। তারা আপিল করে আদালতকে বলল, আদালত আইন পরিবর্তনে এমন সুপারিশ করতে পারে কি না। তবে ১৫টি নির্দেশান সব সময়ই বলবৎ ছিল।
ঢাকাটাইমস: এখন তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা কী যুক্তি দেখিয়েছেন?
ইদ্রিসুর রহমান: এখনো তারা একই যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। আইন সংশোধন করতে আদালত সুপারিশ করতে পারে কি না?
ঢাকাটাইমস: হাইকোর্টের নির্দেশনায় কী বলা হয়েছিল?
ইদ্রিসুর রহমান: ১৫টি নির্দেশনার মধ্যে প্রথমটি ছিল ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশন বা আটকাদেশ দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। এখানে পুলিশকে কতগুলো বিশেষ ক্ষমতা দেয়া আছে। ওই ক্ষমতায় পুলিশ এখন আর কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না।
ঢাকাটাইমস: সাদা পোশাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে?
ইদ্রিসুর রহমান: হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ তার পরিচয় দেবে। প্রয়োজনে উপস্থিত অন্যান্য ব্যক্তিকেও তার পরিচয়পত্র দেখাবে। যেকোনো পোশাকেই যাক না কেন, গ্রেপ্তারের আগে তাকে অবশ্যই পরিচয়পত্র দেখাতে হবে।
ঢাকাটাইমস: ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের পর পুলিশের করণীয় সম্পর্কে কী বলা হয়েছে নির্দেশনায়?
ইদ্রিসুর রহমান: গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে গ্রেপ্তারের কারণ কেস ডায়েরিতে লি তে হবে। যেমন- আমলযোগ্য অপরাধ, অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ, যে পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তথ্যের উৎস এবং তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার কারণ, স্থানের বর্ণনা, সময় এবং গ্রেপ্তারের সময় উপস্থিত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা।
থানায় আনার তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে। বাসস্থান বা কর্মস্থল ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হলে থানায় আনার এক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ তার আত্মীয়-স্বজনকে টেলিফোনে বা বিশেষ বার্তাবাহকের মারফত গ্রেপ্তারের সংবাদটি জানাবে।
ইদ্রিসুর রহমান: গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ অফিসার গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলে তিনি আঘাতের কারণ লিখবেন এবং চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে বা সরকারি চিকিৎসকের কাছে নেবেন এবং চিকিৎসকের সনদ নেবেন।
ঢাকাটাইমস: আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে...
ইদ্রিসুর রহমান: গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী পুলিশ তার পছন্দমতো আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে বা দেখা করতে দেবেন। আইনজীবীর সঙ্গে তার সাক্ষাতের বিষয়টি অধিকার। সেটি দিতে হবে।
ঢাকাটাইমস: তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার বিষয়ে কী আছে?
ইদ্রিসুর রহমান: গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেট যদি সন্তুষ্ট হন, তাহলে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেবেন। অন্যথায় তাকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি দেবেন।
ঢাকাটাইমস: গ্রেপ্তারের বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট না হলে...
ইদ্রিসুর রহমান: গ্রেপ্তারের কারণ সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট না হলে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারকারী পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২২০ ধারায় অপরাধ করার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১)(সি) ধারা অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।
ঢাকাটাইমস: রিমান্ডের বিষয়ে নির্দেশনা কী?
ইদ্রিসুর রহমান: গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ বিস্তারিত কারণ লিখে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করবে। ম্যাজিস্ট্রেট তাতে সন্তুষ্ট হলে সর্বোচ্চ তিন দিনের জন্য রিমান্ডের অনুমোদন দেবেন। কারাফটকে কাচের তৈরি ঘরে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে, যাতে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়-স্বজন বা আইনজীবী জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যটি দেখতে পারেন। কিন্তু তারা শুনতে পারবেন না।
পুলিশ হেফাজতে নেয়ার আগে তাকে ডাক্তারি পরীক্ষা এবং জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া গেলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দ-বিধির ৩৩০ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ঢাকাটাইমস: হেফাজতে মৃত্যু হলে?
ইদ্রিসুর রহমান: থানা বা পুলিশ হেফাজত বা জেলখানায় আটক ব্যক্তির মৃত্যু হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার তৎক্ষণাৎ তা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাবেন। এ সংবাদ পাওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করার জন্য দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে যাবেন। মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন তৈরি ও ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করবেন।
ঢাকাটাইমস: মিছিল ও সমাবেশ থেকে গ্রেপ্তার করতে দেখা যায়। এখন কি পুলিশ তা পারবে?
ইদ্রিসুর রহমান: এখন মিছিল বা সমাবেশ থেকে গণগ্রেপ্তার করতে পারবে না।
ঢাকাটাইমস: নতুন করে আপিল বিভাগ গাইডলাইন দিলে হাইকোর্টের নির্দেশনা কী বহাল থাকবে?
ইদ্রিসুর রহমান: পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে বোঝা যাবে কী হবে। তবে আমি মনে করি, হাইকোর্টের নির্দেশনা বহাল থাকবে।
ঢাকাটাইমস: আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আইন তৈরি করতে সরকার কি বাধ্য?
ইদ্রিসুর রহমান: সরকার যেভাবে ইচ্ছা আইন তৈরি করতে পারে। তবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে আদালত ব্যবস্থা নিতে পারে।
ঢাকাটাইমস: তাহলে সরকার আদালতের নির্দেশনা না মেনেও আইন তৈরি করতে পারে?