প্রকাশ : ১৪ জুন, ২০১৬ ১৪:৪৭:১০আপডেট : ১৬ জুন, ২০১৬ ১৯:৪৫:১০
শিক্ষক মোহাম্মদ শফি
সব সঞ্চয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান
শিক্ষকতা তার কাছে আবেগের বিষয়। দীর্ঘ পেশা ছেড়ে অবসরের অফুরন্ত সময় ভালো লাগে না মোটেও। তাই ফিরে ফিরে আসেন ছাত্রদের কাছে, ফিরে আসেন তার প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বছর প্রাণিবিদ্যা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৮ সালে চার বছরের অবৈতনিক ছুটি নিয়ে যান ইরাকে। ১৯৮২ সালে দেশে ফিরে আবার যোগ দেন নিজ বিভাগে। ১৯৯৮ সালে মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ খোলার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিববিদ্যালয়ে। যতটুকু সময় শিক্ষাঙ্গন আর ছাত্রদের সঙ্গে কাটে, সেটাই তার কাছে শ্রেষ্ঠ সময়।
৩২ বছরের শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একুয়াকালচার ও ফিশারিজ বিভাগ থেকে অবসরে যান অধ্যাপক মোহাম্মদ শফি। কিন্তু মায়া ছাড়তে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের। নিয়মিত নিজের কোর্সগুলো পড়ান তিনি। সপ্তাহে দুইদিন হলেও আসেন তার বিভাগে, পরীক্ষা থাকলে আরও একদিন বেশি আসেন।
অধ্যাপক শফির শিক্ষকতা পেশা শুরু সেই ১৯৭২। সে বছর সহকারী অধ্যাপক দ্যালয়। পরে একুয়াকালচার ও ফিশারিজ নামে নতুন বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
কেবল ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ বা অভিজ্ঞতা বিনিময় নয়, তাদের সুবিধা করে দিতে নিজের পক্ষে সম্ভব সব কিছুই করেছেন মোহাম্মদ শফি। এমনকি নিজের সারা জীবনের সঞ্চয় ৪০ লাখ টাকাও দান করেছেন বিভাগের ভবন নির্মাণে। এই সময়ের সঙ্গে সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছেন এই শিক্ষক, কথা বলেছেন তার স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা আর অপূর্ণ বাসনা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামসুদ্দোহা মৃধা।
সারা জীবনের সঞ্চয়ই দান করে দিলেন?
টাকার অভাবে ১৪ বছর ধরে একতলায়ই আটকে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের ভবন নির্মাণের কাজ। ক্লাসরুম সংকট, অপরিসর গবেষণাগারের কারণে ঠিকমত শিখতে পারে না ছাত্ররা শিক্ষকদের ঠিকমতো জায়গা হয় না। তাই ভাবলাম, আমি টাকা দিয়ে কী করবো?
টাকা থাকলেও সবাই তা বিলিয়ে দিতে পারে না...
আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি। বৃটিশ আমলে উনি বড় ব্যাবসায়ী ছিলেন। সে সময় বাংলার মানুষ বিশেষ করে মুসলমানদের অবস্থা ছিলো শোচনীয়। বাবা তখন সাধারণ মানুষেকে নানা ভাবে প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। আমিও খানিকটা বাবার মতোই হয়েছি বলতে পারেন। ছাত্র শিক্ষকের কষ্ট আমার সহ্য হয়নি। আমি চেয়েছি বিভাগের ছাত্র শিক্ষকদের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে। বর্তমানে বিভাগের দ্বিতীয় তলার কাজ শেষের দিকে। আশা করি শীঘ্রই তৃতীয় তলার কাজ ধরা যাবে।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে আপনি সমাজকে কি বার্তা দিতে চাচ্ছেন?
আমি আদর্শ জীবনে বিশ্বাস করি। আদর্শ জীবন আর সুখী জীবনের পার্থক্যটা হলো যারা সুখী জীবন পেতে চান, তারা সারা জীবন আয় করেন এবং নিজের মত করে উপভোগ করেন। আর যারা আদর্শ জীবনে বিশ্বাসী তারা অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ-সব কিছু নিয়েই চিন্তা করেন। কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবেন না, অন্যের চিন্তাও মাথায় থাকতে হবে। সেই ধ্যান বা চিন্তা থেকেই আলোর পথে হাঁটার চেষ্টা করছি। তাছাড়া সমাজে এখনও ভালো মানুষের অভাব নেই। অন্যদের জীবনকে সুন্দর ও নিরাপদ করতে কাজ করছেন তারা। তাদের জন্যই আমরা স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত করছি। আমি আশা করি, আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থেকে সমাজের অগ্রগামীরা আরও ভূমিকা রাখতে অনুপ্রেরণা পাবে।
সমাজে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাও কম নয়। চারপাশেই আছেন তারা, তাদের বদলে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নিলেন কেন?
সামর্থ্য হলে দরিদ্রপীড়িত মানুষদের জন্য পারিবারিকভাবে কিছু করার ইচ্ছে আছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন নিজের পাঠদানের আঙিনায় অযতœ অবহেলা দেখে আমি ক্লান্ত। ছাত্র শিক্ষকদের দুর্ভোগ আমাকে ব্যাথিত করে তুলেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি বেঁচে থাকতেই এই মৎসবিজ্ঞান বিভাগকে একটি আদর্শ বিভাগ হিসেবে দেখে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা কি পেয়েছেন?
নানা সময় বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, বিলম্ব হলেও একটা সময় তাদের দৃষ্টি আকর্ষণে আমি সক্ষম হয়েছি। বিশেষ করে উপাচার্য আমাকে বেশ সহযোগিতা করেছেন।
আপনার সন্তানরা এই দানকে কীভাবে নিয়েছেন?
আমার দুই ছেলে দেশের বাইরে পড়াশুনা করছে। সেখানে তারা প্রতিষ্ঠিত ও বেশ স্বচ্ছল বলা চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুদান দেয়ার বিষয়ে তাদের সঙ্গেও আমি কথা বলেছি। দুইজনই আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। কেবল মানসিকভাবে পাশে থাকা নয় তারা আমাকে নানা সময় আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করে।
আপনার ভবিষ্যত আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চয় কথা হয়েছে...
আগেই বলেছি, দুটি ছেলেই আমার বেশ প্রতিষ্ঠিত, একটি মেয়ে ছিলো বিয়ে দিয়েছি কিছুদিন হলো। ফলে পারিবারিকভাবে আমার কোন পিছুটান নেই। ভবিষ্যত নিয়েও দুশ্চিন্তা করি না। একভাবে কেটে যাবে। তা ছাড়া স্ত্রীরও তেমন চাহিদা নেই। তিনিও বরাবর আমাকে শিক্ষকতার কাজে সহযোগিতা করেছেন। তার উৎসাহ না থাকলে সাম্প্রতিক এই কাজটাও করতে পারতাম না।
বলতে গেলে সঞ্চয়ের পুরোটাই তো বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দিলেন। আপনার সংসার চলে কীভাবে?
বিভাগ থেকে কিছু সম্মানী পাই। আর গবেষণা এবং প্রকল্পের কাজ থেকেও বেশ ভালই টাকা আসে। ছেলেরাও তো দেখে, আর আমার বিলাসিতার অভ্যাস নেই তাই, সমস্যা হয় না খুব একটা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারই কি দান করলেন?
না, এর আগেও ৩০ লাখ টাকা দিয়েছি। এই টাকা দিয়েই আমার বিভাগের বহুতল ভবনের ভিত্তি (ফাউন্ডেশন) নির্মাণ করা হয়েছে। বাবা-মায়ের নামে একটি ট্রাস্ট ফান্ডও করা হয়েছে, এ থেকে গরিব ও মেধাবীদেরকে বৃত্তি দেয়া হয়।
এই সব টাকাই কি আপনার নিজের আয় করা?
বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো। বগুড়া শহরেও বেশ কিছু জমিজমা আছে। ফলে শিক্ষকতা শুরুর পর আমাকে কেবল বেতনের টাকার উপর নির্ভর করতে হয়নি। আবার বেতনের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় বিদেশে গবেষণা করতে গিয়েছি। সেখান থেকেও বেশ আয় হয়েছে। পারিবারিক খরচ বাদে সঞ্চয় ভালোই হয়েছে। দুই ছেলেও বিদেশ থেকে ভালো অংকের টাকাই দেয়। ফলে অনুদান দিতে গেলে আমার কখনও ভাবতে হয়নি।
এই দানের পর ক্যাম্পাস ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আপনাকে বেশ আলোচনা হচ্ছে...
আমি ওসব দেখিনি। তবে লোকমুখে শুনছি ফেসবুকে অনেকে এটা নিয়ে ইতিবাচক বলছেন। আমি মনে করি আমি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত। তবে আমি প্রশংসা পাওয়ার আশায় এই কাজ করিনি। আমার ভেতরের তাগিদ, ছাত্রদের জন্য কিছু করার বাসনা থেকে এই কাজ করেছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কমিটি ও একাডেমিক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মৎসবিজ্ঞান বিভাগের নির্মাণাধীন নতুন ভবনের নাম আমার নামে করা হচ্ছে, এটা অবশ্য বেশ আনন্দের। এই বিভাগে আমার নাম সব সময় থাকবে-এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?
মৎসবিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
এই বিভাগে এখন যারা শিক্ষক তাদের অনেকেও আমার ছাত্র। কখনও কখনও বিভাগে দুঃসময় গেছে। এটা যেন আর কখনো ফিরে না আসে এটা আমার অন্যতম চাওয়া। ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে বলি, তোমরা বিদেশ যাও, নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করো, নতুন কলাকৌশল শিখো, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করো। কিন্তু বাংলাদেশে ফিরতে ভুলো না। দেশের জন্য কাজ করো।
অবসরের পরও কেন বিভাগে আসেন?
মৎসবিজ্ঞান বিভাগে খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকতে বেশ ভাল লাগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আসেন না, সেই সময়টায় কী করেন?
ঘরে নাতি নাতনি আছে, তাদের সঙ্গে সময় কাটাই, পড়াশোনা তো জীবনের অংশই হয়ে গেছে। পত্রিকা আর বইয়ে চোখ না বুলালে তো দিনটা কেমন কেমন লাগে। আর শেষ বয়সে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগটাও আবার ঝালাই করে নিচ্ছি। পাশাপাশি মাছ নিয়ে নানা গবেষণায় জড়িত আছি। এ জন্য মাছের খামার ও নদী পরিদর্শনেও যেতে হয়। সব মিলিয়ে সময়টা বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে।