গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন জঙ্গি রয়েছে, যারা বেশ ধনী পরিবারের সন্তান। পড়ালেখা করেছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইএস দাবি করেছে নিহত জঙ্গিরা তাদের সদস্য। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার সব সময় বলে আসছে, এখানে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই।
বাংলাদেশে বিদেশি নিহতের ঘটনায় আইএসের সম্পর্ক, দেশে জঙ্গিবাদের বিকাশ, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়া- এসব বিষয়ে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অপরাধবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের (ঢাবি) অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকাটাইমসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মোসাদ্দেক বশির।
ঢাকাটাইমস: সরকার দেশে আইএসের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় আইএস প্রতিনিয়ত তথ্য দিয়েছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
জিয়া রহমান: বাংলাদেশে সংঘটিত এর আগের হত্যাকা-গুলোতেও আইএসের পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করা হয়েছে। এই ঘটনায়ও করা হয়েছে। তবে আমাদের দেশে আইএস বলে কোনো জিনিস নেই। আইএসের যে মূল্যবোধ, তাদের যে লক্ষ্য, তা বাংলাদেশে নেই।
ঢাকাটাইমস: গুলশানের ঘটনার সঙ্গে তাহলে কারা জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করছেন?
জিয়া রহমান: সারা পৃথিবীর জঙ্গিগোষ্ঠীকে আইএসের সঙ্গে মেলালে হবে না। হামাস কি আইএস? আল-কায়েদা কি আইএস? এখানে জেএমবি আছে, হরকাতুল জিহাদ আছে। এইগুলো কি জঙ্গি সংগঠন নয়? আইএসের উপকরণ আমাদের দেশে নেই। আইএস আছে কি না এই আলোচনাটাও অর্থহীন। কয়েক দিন আগে আমেরিকায় যখন আক্রমণ হলো, তখনো আইএসের আপডেট দেয়া হয়েছে। কিন্তু বারাক ওবামা কি স্বীকার করেছেন, হামলার সঙ্গে আইএস জড়িত? অথচ আমাদের দেশে জঙ্গি হামলা হলেই বলা শুরু হয় এটা আইএসের কাজ।
ঢাকাটাইমস: গুলশানের ঘটনার সঙ্গে বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা থাকতে পারে কি না?
জিয়া রহমান: বিদেশি কেন থাকবে না। এখানে টাকা-পয়সার খেলা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। লাখ লাখ ডলার বাইরে ব্যয় করা হয়েছে। তারা বুদ্ধি দিয়ে এসব করছে। এটা আইএস করছে, এটা তারা ফোকাস করছে। এতেই তো প্রমাণ হয় এর সঙ্গে বিদেশিরা জড়িত।
ঢাকাটাইমস: আগে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মাদ্রাসার ছেলেরা জড়িত বলা হতো, এখন দেখা যাচ্ছে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়িত।
জিয়া রহমান: জঙ্গি ইস্যুতে শুধু মাদ্রাসাকে দোষারোপ করলে হবে না। আবার বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়কেও দোষারোপ করলে হবে না। একেক জঙ্গিগোষ্ঠী একেকভাবে কাজ করে। যারা মাদ্রাসায় পড়ছেন তারা খারাপ সেটা বলা ঠিক নয়, আবার বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে যারা পড়ছে তারা যে সবাই খারাপ সেটাও বলা যাবে না।
ঢাকাটাইমস: দিন দিন জঙ্গিবাদের বিস্তার কিন্তু ঘটছে...
জিয়া রহমান: সারা পৃথিবীতেই এখন জঙ্গিবাদ দেখা যাচ্ছে। সারা বিশে^ই সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। আগে আমরা দেখতাম পুঁজিবাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল সমাজতন্ত্রের। যেহেতু সমাজতন্ত্রের পতন হয়ে গেছে, পুঁজিবাদী আগ্রাসনটা শক্তিশালী হয়েছে। নাইন-ইলেভেনের পরে মুসলমানরা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছে। এখন যারা উচ্চশিক্ষিত তাদের মধ্যে এই জিনিসটা রি-অ্যাক্ট করছে বেশি। বিদেশেও যুবকদের মধ্যে মুসলিম আইডেনন্টিটি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকাটাইমস: জঙ্গিবাদের সঙ্গে উচ্চবিত্তের সন্তানদের জড়িত হওয়ার পেছনে কারণ কী থাকতে পারে?
জিয়া রহমান: বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে আদর্শের অভাব থাকার কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। তাদের মধ্যে অহং তৈরি হচ্ছে। একসময় কচিকাঁচার মেলা ছিল, খেলাঘর ছিল, ফুটবলের মাঠ ছিল, এলাকাভিত্তিক ক্লাব ছিল, ফলে যুবসমাজ এগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল। যুবকরা এসব নিয়ে মেতে থাকত। এখন এসব উঠে গেছে। তারা কম্পিউটারে বসে থাকে। জঙ্গিরা এটার সুযোগ নিচ্ছে। প্রতিভাবান ছেলেদের তারা বেছে নিচ্ছে। জঙ্গিরা প্রতিভাবান ছেলেদের মটিভেটেড করছে যে, মুসলিমরা নিগৃহীত হচ্ছে। এসব বুঝিয়ে তাদের দলে ভেড়াচ্ছে। জঙ্গিদের দল শক্তিশালী করছে।
জিয়া রহমান: আমাদের মনিটারিং করতে হবে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কী পড়াচ্ছে, মননশীলতা কী আছে। তাদের মানবিক মূল্যবোধ ও চেতনা বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না, দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে কি না। এসব বিষয় যদি আমরা গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ না করি, তাহলে জঙ্গিগোষ্ঠী এসব ছেলেমেয়েকে তাদের পকেটে পোরার সুযোগ পাবে।