‘মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্নতাই জঙ্গিবাদে ধাবিত করছে ওদের’
ঢাকা: জঙ্গি সমস্যা আমাদের দেশে সম্প্রতি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সমস্যাটি নতুন না হলেও সমাজের বিত্তবানদের ছেলে মেয়েদের জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে যাওয়ার এই প্রবণতাটি নতুন বলতেই হবে।তাছাড়া শোলাকিয়াসহ রাজধানীর হটি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনা থেকে শুরু করে মিরপুরের কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের সাহসী পদক্ষেপ আমাদেরকে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে। জঙ্গিবাদের এই বিস্তারে আমাদের গলদটা ঠিক কোথায়? সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার উদাসীনতা, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা নাকি মূলধারার সংস্কৃতি থেকে ধনির দুলালদের বিচ্ছিন্নতা এবং সেই থেকে হতাশা?
এসব বিষয় নিয়ে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অপরাধবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপকড. জিয়ারহমান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি সামসুদ্দোহা মৃধা।
ঢাকাটাইমস: জঙ্গিবাদ আগেও ছিল, নতুন হচ্ছে বিত্তবানদের ছেলেদের জঙ্গিবাদে জড়ানো। এসব উচ্চ শিক্ষিত ছেলেদের টার্গেট করার কী কারন বলে মনে করেন।
জিয়ারহমান: সমাজের বিত্তবানদের টার্গেট করার কারনটা খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে- সম্প্রতি আমাদের সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের সমাজে দারিদ্রের পরিমাণ বেশি ছিল আগে। মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থায়ও অনেক পরিবর্তন এসেছে।মানুষের জীবন ধারণেও এসেছে পরিবর্তন। নতুন একটা শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে। একইসাথে এই যে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম তার কৌশলে বা তার কাজে পরিবর্তন এসেছে। এটা পুরোপুরি বিশ্বায়নের সাথে সম্পৃক্ত এবং এটি যেহেতু জঙ্গিবাদ তাই এক্টিভিটিজ অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে। এগুলো সম্পর্কে বিশদ জানতে গবেষণা হওয়া দরকার। নতুন যে উচ্চবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে এদের সন্তানরা বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। যার ফলে তাদের মধ্যে একধরণের হতাশা কাজ করে। দেশের প্রতি বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে যে ঐতিহাসিক এক ধরণের ভালোবাসা তৈরি হওয়ার কথা সেখানেও কিছুটা ঘাটতি আছে। এই দুর্বলতা গুলো চিহিৃত করেই জঙ্গিরা এদের টার্গেট করছে। তরুণদের এই বিচ্ছিন্নতা বা চেঞ্জটা ন্যাচারালি ঘটেছে, তবে দারিদ্র্যতার সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক এখনো আছে। আছে রাজনীতির সম্পর্ক। উচ্চবিত্ত বা মাদ্রাসা ছাত্র যাই বলি এদের উভয়ের পেছনেই রাজনৈতিক শক্তি আছে। এরা উভয়কেই রাজনৈতিকভাবে একত্রিত করছে। যার কারনে গুলশান, শোলাকিয়া, কল্যাণপুরে আমরা উচ্চবিত্ত এবং মাদ্রাসা ছাত্র উভয়ের সম্পৃক্ততাই লক্ষ করেছি। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করা, দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে নেয়া, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন শক্তি ক্ষমতায় বসানোও তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
ঢাকাটাইমস: জঙ্গি সমস্যা সেই বাংলা ভাইয়ের আমল থেকে। আইনশৃঙখলা বাহিনী থেকে বলা হচ্ছিল তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা আমাদের সব হিসাব পাল্টে গেল। আমাদের গলদটা কোথায় বলে মনে করেন।
জিয়ারহমান: গলদ হচ্ছে যে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অর্থাৎ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আধুনিকায়ন করা হয়নি এবং স্বাধীন সংস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া রিসোর্সেরও অভাব আছে। ম্যান পাওয়ারেও ঘাটতি, প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনীর অভাবসহ সবকিছু মিলিয়েই বলতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে যেহেতু আমাদের পুলিশের ডেভেলপমেন্ট হয়েছিল একটা ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক অবস্থার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশরা তাদের পলিটিকাল স্বার্থ হাসিল করার জন্যই এ বাহিনী সাঁজিয়েছিল। পুলিশের ভেতর থেকে এখনো সেই সংস্কৃতি ভাঙেনি। এখনো সেই সেকেলের আইন দিয়ে পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। করামশান, নেপোটিজমের সঙ্গে পুলিশে যোগদান করার সময় প্রচুর অর্থ বাণিজ্য হওয়ার প্রভাবে পুলিশ যে একটা সার্ভিস হিসেবে ডেভেলপ করার কথা সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
যেহেতু ইন্ডিপেনডেন্ট ক্যাপাসিটি নেই, ফলে কোননা কোনভাবে যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের পক্ষেই কাজ করতে হয় পুলিশকে। পুলিশের মধ্যে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করার বিরাট অভিজ্ঞতাও আমরা দেখিনা।
তবে আশার কথা হচ্ছে ১০-১৫ বছর আগের তুলনায় অনেক ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। যেমন আমরা দেখতে পাচ্ছি পুলিশের মধ্যে অনেক ইউনিট হয়েছে। এখন যেটা মনে করি তাদের প্রত্যেকের আলাদা অটোনমি করার এ কাজটি করতে হলে উচিত হবে আইন পরিবর্তন করে তাদেরকে ক্ষমতায়ন করা এবং তাদেরকে জবাবদিহিতার পর্যায়ে আনা হলে এই গলদ বা সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।
ঢাকাটাইমস: জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।আপনিও কি তাই মনে করেন?
জিয়ারহমান: এটা আমি বিশ্বাস করিনা। এই জায়গায় আমি আস্থা রাখতে চাই। কল্যাণপুরের অভিযানকে সামনে রেখে গোয়েন্দা প্রধান মনিরুল ইসলামের কথাই যদি বলেন ওনার একটা হাইট আছে, ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, গ্রহণযোগ্যতা আছে সোসাইটিতে। এই সমস্ত প্রশ্ন যারা উত্থাপন করছে তারা মূলত কোননা কোনভাবে মোটাদাগে জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে। তবে কেউ কেউ আবার সঠিক সমালোচনা করার চেষ্টা করছে। তবে আমি বলব সমালোচনার সময় এটা না। এটা আগে জানতে হবে যারা সেখানে ছিল তারা জঙ্গি ছিল কীনা। কল্যাণপুরের ঘটনার ক্ষেত্রে আমি মনে করি পোশাকের সংশ্লিষ্টতাই যথেষ্ট। জঙ্গি ছিল বিধায় হলি আর্টিজানের ৯ জনের বেলায় আমরা প্রশ্ন তুলিনি। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এছাড়াও আমার বিভাগে ফরেনসিক প্রধান রয়েছেন তিনি পরীক্ষা করে বলেছেন গুলশান হামলাকারীদের সাথে কল্যাণপুরের এদের সংশ্লিষ্টতা আছে।
জিয়ারহমান : এটা সহজ কথা। জঙ্গিবাদের কথা যদি বলি আমরা দেখি যে জামায়াত -শিবিরের মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রগ কাটার প্রথা চালু হয়েছে। এরপর যারা আফগানিস্তানে যুদ্ধে গিয়েছিল সে আফগান থেকে ফিরে আসা লোকদেরও কোননা কোনভাবে জামায়াতের সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড জড়িত। জেএমবি প্রধানের জবানবন্দিতেও জানা যায় সেও এক সময় জামায়াতের সাথে যুক্ত ছিল।ফলে আল্টিমেটলি কোননা কোনভাবে আমরা দেখছি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের সাথে জামায়াতে ইসলাম, ওহাবিজম এবং এদের আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত দলগুলোই জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত। একমাত্র হিযবুত তাহরীর যেটা কীনা একটু আলাদা করা যায়। তাদের ক্লাশ, ক্যারেক্টার এবং তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে এটাকে একটু ভিন্ন এবং শহর কেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষিত ছেলেদের সম্পৃক্ততা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে এই সমসাময়িক সময়ে যে হত্যাযজ্ঞ বা জঙ্গির উত্থান দেখি এটার সাথে সরাসরি গণজাগরণ মঞ্চের বিষয়টি জড়িত। মঞ্চ হওয়ার পরেই কিন্তু আমরা দেখেছি যে ব্লগার হত্যার বিষয়টি সামনে চলে আসল। কাজেই মোটামুটি এটা বলাযায় যে, জামায়াতের এজেন্ডা, আদর্শের পক্ষের হওয়ার কারনেই তারা সমন্বিত ভাবে এসব করছে।
ঢাকাটাইমস: পিতামাতাকে না বলে সন্তান ঘরছেড়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এখানে পিতামাতা বা অভিবাবকদের কী কোন দায় নেই?
জিয়ারহমান: অবশ্যই পিতামাতার এখানে একটা দায় আছে। তবে পিতামাতার দায় থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে আধুনিয়ানের সাথে পরিবারের যে সনাতনী ভূমিকা বা ঐতিহ্যগত ভূমিকায় বড় পরিবর্তন এসেছে। পৃথিবীর বাস্তবতা, পৃথিবীর ইতিহাস এটাই। আমেরিকান, কানাডিয়ান, ইউরোপিয়ান সোসাইটিগুলোর দিকে যদি আপনি তাকান তাহলে দেখবেন নগরায়ন, শিল্পায়ন, আধুনিকায়ন এসবের ফলে সেখানে যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের শহর অঞ্চলগুলোতেও লক্ষণীয়। একটা পরিবারের ঐতিহাসিক ভূমিকা, ভালোবাসা, স্নেহ, সামাজিকীকরণ এসবের বিরাট অবদান আছে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সামনের দিকে এগোতে থাকলে পরিবারের ভূমিকাটা কমতে থাকে ব্রোকেন ফ্যামিলি বেড়ে যায়। উন্নতবিশ্বে পরিবারের অবদানটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন করে থাকে কিন্তু আমাদের সে সুযোগ নেই। যারফলে এই জটিল সমস্যার সৃষ্টি।
ঢাকাটাইমস: জঙ্গিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যে আওয়ামীলীগ বিএনপির পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিয়ে কিছু বলুন।
জিয়ারহমান: আমি মনে করি কেউ যদি কাজ করতে চায় আনুষ্ঠানিক ঐক্যটা আসলে এখানে মুখ্য না। বিএনপির এখন পলিটিকাল অবস্থা এতই শোচনীয় যে তারা এখন কোননা কোনভাবে খড়কুটো নিয়ে বাঁচতে চাচ্ছেন। এটা বিএনপির ব্যর্থতা এইজন্য বলব যে, বিএনপির নিজের একটা ভূমিকা থাকা উচিৎ। তাদের থিঙ্ক ট্যাংক যারা তারা জামায়াতকে ছাড়তে বলছে অথচ বিএনপি ছাড়ছেনা । আবার সে সরকারকে বলছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেন আসলে এরা দ্বিমুখীতার মধ্যে আছে। আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমালোচনা করছেন এ অবস্থায় ঐক্য চাওয়াটাকে হাস্যকর মনে হচ্ছে। জঙ্গিবাদের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করে তাদের উচিত জঙ্গি দমনে রাস্তায় নামা। ঐক্য কোন দেশেই আনুষ্ঠাকিতায় হয়নি সঙ্কটকালে আপনা আপনি ঐক্য হয়ে যায়।
ঢাকাটাইমস: জঙ্গি দমনে সরকারের কী করনীয় আছে বলে মনে করেন?
জিয়ারহমান: জঙ্গিবাদ দমনে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এদের ভিন্নভিন্ন ক্ষমতায়ন করতে হবে। রিসোর্স বাড়াতে হবে ট্রেনিং দিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে এদের যেন ঘটনা ঘটার আগে এরা পূর্বাভাস দিতে পারে। দ্বিতীয়ত সোসাইটি থেকে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ছেলেমেয়েদের কাছেই যেন এরা ঘেষতে না পারে। অপরাধীদের রুট লেভেল থেকে বের করতে হবে। আমাদের সমাজের অনেকেই সাম্প্রতিক অবস্থার জন্য তরুণ সমাজ কে দায়ী করে এটা সম্পূর্ন ভুল। তরুনদের এক্ষেত্রে দোষ দেয়া চলেনা বরঞ্চ এরা আমাদের সম্পত্তি। তাদের সাথে বেশি বেশি মেশা উচিৎ। তাদের সুখ দু:খের খোঁজ রাখা উচিৎ। যতদূর সম্ভব এদেরকে আমাদের মূলধারার কালচারের সম্পৃক্ত করতে হবে। কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিজ বৃদ্ধি করতে হবে।স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় খেলা ও সার্বিক বিনোদনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।