হুমায়রা মোস্তফা সোহানী। প্রখ্যাত ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। কাজ করছেন দেশের নামি দামী অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। নিজের শ্রম, মেধা, ধৈর্য্য ও কর্মকূশলতা দিয়ে নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান সোহানী’স ইন্টেরিয়র। স্বপ্ন দেখেন সম্ভাবনাময় নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নিয়ে যেতে চান অনন্য উচ্চতায়। দায়িত্ব পালন করছেন নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার অব কমার্সের পরিচালকের। যুক্ত আছেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিহাব উদ্দিন।
ব্যবসায়ের শুরু কিভাবে ?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার পর সিদ্ধান্ত নিলাম গতানুগতিক অন্য সবার মতো চাকুরির পেছনে না ছুটে নিজেকে উদ্দ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে দেশ, সমাজ ও পরিবারের জন্য ভালো কিছু করতে পারব। শুরু থেকেই ইন্টেরিয়র ডিজাইনের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল। সে আগ্রহ থেকে এ বিষয়ের উপর বিশেষ কোর্সও সম্পূর্ণ করে ফেলি। এরপর এ সেক্টরের খুটিনাটি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য যোগ দিই দেশের নামকরা একটি আর্কিটেকচার ফার্মে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হিসেবে ওই ফার্মে বেশ কিছুদিন কাজ করার পর অনুভব করলাম কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা দিয়েই তো উদ্দ্যোক্তা হিসেবে নিজেই কিছু একটা শুরু করতে পারি। এরপর শুরু হলো আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথচলা। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গড়ে তুললাম আমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান “সোহানী’স ইন্টেরিয়র”। বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠান সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের সরকারী বেসরকারী অনেক নামী-দামী প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। দেশের অনেক শপিংমল থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকাগুলোতে অবস্থিত অনেক বাড়ী ও কর্পোরেট অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন আমার প্রতিষ্ঠানের করা।
আমাদের দেশে ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের সম্ভবনা নিয়ে কি বলবেন?
আধুনিক স্থাপনার অভ্যন্তরীন সৌন্দর্য বর্ধনে প্রধান ভূমিকা রাখছেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা। মুলত একটি প্রতিষ্ঠানের অন্দরমহলের সাজ-সজ্জা বৃদ্ধিতে তারা মূল ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশের ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের কাজের সুযোগ দিন দিন বাড়ছে। তার মূল কারন একটি নতুন ভবন যখন তৈরী হয় সে ভবনে অফিস কিংবা বাসা যাই হোকনা কেন ব্যবহারকারীরা চাইবেন সেটিকে নিজের চাহিদামত সাজাতে। এক্ষেত্রে একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ছাড়া তা কখনোই সম্ভব নয়। ফলে বিশ্বের অন্যান দেশের মতো আমাদের দেশেও ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের চাহিদা বাড়ছে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং মূলত একটি ক্রিয়েটিভ পেশা। যার ক্রিয়েটিভিটি যত বেশী সে এ সেক্টরে তত বেশী সাফল্য লাভ করতে পারবে।
সামাজিকভাবে বাংলাদেশের নারীদের সম্মানজনক অবস্থান তৈরী হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
সব প্রতিকূলতাকে জয় করে আজকে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের নারী সমাজ নিজের যোগ্যতায় পুরুষের সঙ্গে নির্মাণ করছে সমতার সমাজ। এ সমতার সমাজ আমাদের নিয়ে যাচ্ছে শক্তিশালী মানবিক পৃথিবী নির্মানের দিকে। বাংলাদেশের নারীরা তাদের যোগ্যতাবলে রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা-বানিজ্য থেকে শুরু করে সব সেক্টরেই ভালো অবস্থানে পৈাছে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলিয় নেত্রী, স্পিকার, সংসদ উপনেতা, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়রের অনেকগুলো পদ নারীদের দখলে। দেশের বিভিন্ন সেক্টরে পুরুষের পাশাপাশি নারীর এ অংশগ্রহন বেশ ইতিবাচক।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীরা এখনও বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
এ দেশের একটি গোষ্ঠি এখনও ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী সমাজকে গৃহবন্দী করে রাখতে চায়। এদেশের কিছু কু-সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এখনও নারীকে ভোগ্যপণ্য মনে করে। তারা নারীদেরকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী রাখতে চায়। তারা নানাভাবে নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে। কোন ধর্মেই নারীর প্রতি বৈষম্য করার কথা বলা হয়নি। আমরা এমন একটি সমাজ কাঠামো চাই যেখানে নারী পুরুষের কোন বৈষম্য থাকবেনা। এখনও আমাদের দেশের অনেক নারী নির্যাতনের স্বীকার হলেও কোন আইনগত সহায়তা পায়না। নারীর আইনগত সহায়তা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে। নারীর আবাসন ও স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা কতটুকু প্রয়োজন?
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এ নারীরাই সফল হলে বাংলাদেশ সফল হবে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ পৃথিবীর দশম স্থানে অবস্থান করছেন। নিঃসন্দেহে এটি ইতিবাচক দিক। রাষ্ট্রীয় অর্থনিতিতে জিডিপির ৬৫ শতাংশই অর্জন নারীর। বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যেও নারীরা ভাল করছে। তাই, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জাতীয় বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে নবীন নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে সরকারের বিশেষ নজর দেয়া উচিৎ। নবীন নারী উদ্যোক্তরা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নিজেদের সু-উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে। সরকারকে নবীনদের নতুন নতুন ধারনাগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিতে হবে।
আপনি চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার অব কমার্স এর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। এ সংগঠন সম্পর্কে বলুন।
নতুন নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ও নারী উদ্যোক্তাদের একই ছাদের নিচে আনার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার। অল্প সময়ের মধ্যে এই সংগঠনটি সারাদেশে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সংগঠনটি ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ন নানা ইস্যুতে ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও নতুন উদ্যোক্তা তৈরী করতে নিয়মিত বিভিন্ন সভা-সেমিনারসহ ট্রেইনিং এর ব্যবস্থা করে থাকে সংগঠনটি। এছাড়াও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য কল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সংগঠনটি। এ সংগঠনের ছায়াতলে চট্টগ্রামের নারী উদ্দ্যোক্তারা মিলিত হয়ে কাজ করছেন দেশের উন্নয়নে। নারী উদ্যোক্তাদের এই প্লাটফর্ম থেকেই তৈরী আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নায়ক ও বিশ্ব বাণিজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব।
ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে কি বলবেন?
আমাদের দেশের তরুন তরুনীরা অনেক সচেতন ও সম্ভাবনাময়ী। তারা অল্পসময়ে নিজেকে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। সাফল্যের শিখরে পৌছাতে হলে প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যা, কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ ও ধৈর্য্য। জীবনে হতাশার স্থান নেই। আতœবিশ্বাস নিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে ঝুঁকি, ত্যাগ ও ধৈর্যের বিকল্প নেই। সফল উদ্যোক্তা হতে হলে শুধু উদ্যোগ নিলেই চলবে না। প্রথমদিকে নিজের উদ্যোগের খুটিনাটি বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। কোন ছোট বিষয়ও মুল্যহীন বলে ফেলে রাখলে চলবে না। নতুন কোন কাজ করতে গেলে অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যা যেমন হতে পারে তেমনি সামাজিক সমস্যাও। কোন সমস্যাকে ছোট করে না দেখে সেগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে এবং সমাধান করতে হবে। কোনভাবেই সমস্যা দেখে পেছানো যাবেনা। কোন একটা উদ্যোগ গ্রহন করার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা সফল হবে এমন ধারনা ভূল। ধৈর্য ধরে কাজ করে যেতে হবে। সততা ও নিষ্ঠা থাকলে সাফল্য আসবেই।