মুন্সিগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। পাকিস্তান পর্বের শেষ তিন বছর আওয়ামী লীগের হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, পরে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার সরকারি দায়িত্ব পান। প্রায় সাত বছর বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। সেই সময়ের অনেক কথা তিনি ১০ আগস্ট ঢাকাটাইমসকে অকপটে বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নতুন কিছু দিক উন্মোচন করেছেন। আজ সাক্ষাৎকারের প্রথম কিস্তি ছাপা হলো। মুন্সিগঞ্জ গিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তায়েব মিল্লাত হোসেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা কিভাবে?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : আমি যখন স্কুলছাত্র তখন একবার ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। আমার ভগ্নিপতি এম আর খান সাহেব সেখানে থাকতেন। ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু জনসভা করতে সেখানে এসেছিলেন। আমি ছোটবেলা থেকেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। তাই সেই জনসভায় ছুটে যাই। ওখানেই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে সচক্ষে দেখলাম। তারও কয়েক বছর পরে ১৯৬৬ সালের দিকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এই জন্য বঙ্গবন্ধুকে জেলে দেয়। পর্যায়ক্রমে আরও অনেক জাতীয় নেতাকে আটক করে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ পর্যায়ে আন্দোলন কিছুটা থেমে যায়। আমি তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও সিরাজুল আলম খান। আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে পরামর্শ করতে প্রায়ই তারা রাজবন্দি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে জেলখানায় যেতেন। তাদের কাছেই কোনো কারণে ছয় দফার আন্দোলনে আমার সক্রিয়তার কথা জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু। আমাকে একদিন নিয়ে যেতে বললেন। নেতারা আমাকে নিয়ে গেলেন রাজবন্দি বঙ্গবন্ধুর কাছে। নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকেই বঙ্গবন্ধু আমাকে লক্ষ্য করে কিছু কথা বললেন। কিছু পরামর্শ দিলেন। তাঁর আচরণে-উপদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেন কখন?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : ১৯৬৬ সালের ছয় দফার পর কয়েক বছর গেল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলো। ১৯৬৯ সালে ১১ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়, উত্তাল আন্দোলন শুরু হয়। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হলেন। জনরোষের কারণে বঙ্গবন্ধুর মামলা প্রত্যাহার করা হয়, তিনি মুক্তিলাভ করেন। এসব আন্দোলনে আমি সক্রিয় ছিলাম।
জেল থেকে বের হওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু আমাকে তাঁর কাছে রেখে দেন। তখন যদিও ইকবাল হলে থাকি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। তবে মিছিল-মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশেপাশেই থাকতাম। ১৯৭০-এর নির্বাচনি প্রচারণায় সারা দেশে, বিভিন্ন জেলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গিয়েছি। আমি ওনার সঙ্গেই থাকতাম। যেখানেই যেতেন আমাকে নিয়ে যেতেন। এই সময়ে কর্মতৎপরতা বেড়ে গেলে বঙ্গবন্ধু আমাকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে নিচের তলায় একটি রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তখন থেকেই ৩২ নম্বরের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাই। তখন থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখতাম।
ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণের মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ঠিক পেছনেই আপনাকে দেখা যায়। এ বিষয়টি কেমন লাগে?
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আসলে তখন বুঝতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিচ্ছেন, আমি পেছনে দাঁড়িয়ে শুনছি। তাঁর কথাগুলোর দিকেই আমার মনোযোগ ছিল। ভাষণের সময় তিনি অনর্গল কথা বলছেন। ভবিষ্যতের দিনগুলোয় কী করতে হবে, তিনি আজই তা বলে দিচ্ছেন। আমার মনে হলো উনি মানুষ নন, স্বর্গীয় কোনো দেবতা এসব কথা বলছেন। তিনি জনতার উদ্দেশে বললেন... ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। ... আমি যদি হুকুম দিবার না পারি…’ পরে কিন্তু এই ভবিষ্যদ্বাণীই বাস্তব হয়েছিল।
এত কাছে থেকে এই ভাষণ শোনার গুরুত্ব ও গভীরতা বুঝতে আমার কয়েক বছর সময় লেগেছে। এখন সাতই মার্চ সম্পর্কে জানতে গবেষকরা, সাংবাদিকরা আমার কাছে আসে। লোকজন বলে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ইতিহাস, আপনি তার সাক্ষী।